শরিফুল ইসলাম পলাশ: ‘সব ঘটনার পেছনেই কোনো না কোনো কারণ থাকে’ এ কথা শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঠিক যেন ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া গল্পের ‘সুখী মানুষ’ খুঁজে পাওয়ার মতো। কবি কিংবা অতি আবেগী না হলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন ‘কারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না, সেটা সম্ভবও নয়।’ যে কারণে কোনো ঘটনার প্রসঙ্গ আসতেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি আমজনতাও ‘কারণ’ খুঁজতে শুরু করে। আর ওই একটি প্রশ্নের জবাব খুলে দেয় বহু রহস্যের জট। যেমনটি ফেলুদা, কিরীটি রায়, ব্যোমকেশ বক্সির রহস্যগল্প কিংবা হালের ক্রাইম প্যাট্রোলের মতো সিরিজগুলোতে আমরা সচরাচর দেখি।
ব্যতিক্রম কেবল সব সম্ভবের এ দেশে, এখানকার পুঁজিবাজারে। কারণ ছাড়া কিছু না হলেও এখানে ‘শেয়ারদর’ কিন্তু ‘অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য’ কিংবা ‘দৃশ্যমান’ কারণ ছাড়াই বাড়ে। শুধু ‘দর বাড়ে’ বললেও কম হবে, বরং ‘শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়’ এমনটি বলা যায়। দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনাবেচা লক্ষ করলে ‘অতিমূল্যায়িত’ হওয়ার বিস্তর প্রমাণ মিলবে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার ভার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া ভালো। আর প্রমাণ দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে ‘নির্ভরযোগ্য ক্লু’ ছাড়া অনুসন্ধান করা কঠিন, তাই ইঙ্গিত দেওয়াই যায়।
পুঁজিবাজারে টেলিকম খাতের শীর্ষস্থানীয় ও বৃহৎ মূলধনি কোম্পানির সঙ্গে বস্ত্র খাতের স্বল্প মূলধনি একটি কোম্পানির লেনদেন চিত্র খেয়াল করলেই ‘অতিমূল্যায়িত’ হওয়ার প্রমাণ মিলবে। যদিও টেলিকম খাতের কোম্পানিটির সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই বস্ত্র খাতের সেই কোম্পানির নেই।
অবশ্য এ পুঁজিবাজারে শক্ত ভিতসম্পন্ন কোম্পানির তুলনায় দুর্বল বা স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদরই বেশি বাড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলোর দিকে নজর দিলে তা-ই মনে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ে? গত কয়েক সপ্তাহে প্রকাশিত শেয়ার বিজের সংবাদের ওপর নজর দিলে শিরোনামে একটি শব্দ অনেকবারই চোখে পড়বে। ‘কারণ ছাড়াই বাড়ছে শেয়ারদর’ এ-জাতীয় সংবাদ প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
প্রকাশিত সংবাদগুলোর তথ্যসূত্র ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কোম্পানির শেয়ারদর একটানা বাড়তে থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই কোম্পানিগুলোকে নোটিস পাঠিয়েছিল পুঁজিবাজারের দেখভালকারী সংস্থাটি। জবাবে কোম্পানিগুলো গতানুগতিকভাবে জানায় সাম্প্রতিক দর বাড়ার পেছনে অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। সে ঘোষণাই ডিএসই তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। নিয়মিতভাবে দরবৃদ্ধি, নোটিস আর একই ধরনের জবাবের কারণে গণমাধ্যমেও বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। আর এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, জগতে কারণ ছাড়া কিছু না ঘটলেও বাংলাদেশে ঘটে। এখানে ‘কারণ ছাড়া’ শেয়ারদর বাড়ে। এ তথ্য রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয়। তারপরও শেয়ারদর বাড়ে, নোটিস পাঠানো হয়। যথারীতি একই উত্তর আসে। প্রায় সব কোম্পানির ক্ষেত্রেই একই উত্তর আসে। দেশে সব ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার ছাপ থাকলেও এ একটি ক্ষেত্রে নেই। ‘দাম বাড়ার কারণ’ প্রশ্নে বছরের পর বছর একটি বাক্যই সামনে আসছে তা হলো, ইন রেসপন্স টু অ্যা ডিএসই কোয়ারি ডেটেড… দ্য কোম্পানি হ্যাজ ইনফরমড দ্যাট দেয়ার ইজ নো আনডিসক্লোজড প্রাইস সেনসিটিভ ইনফরমেশন অব দ্য কোম্পানি ফর রিসেন্ট আনইজ্যুয়াল প্রাইস হাইক। এমনকি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর যখন হু হু করে বাড়ছে, পেছনের ‘অসমর্থিত কারণ’ যখন আলোচিত হচ্ছে, তখনও বিনিয়োগকারীদের ‘কারণ ছাড়া’র বৃত্তেই ঘুরপাক করানো হচ্ছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য, কারণ ছাড়া বিশ্বের কোনো পুঁজিবাজারে শেয়ারদর কমবেশি হয় না। ভালো-মন্দ খবরের ওপর ভর করেই কোম্পানির শেয়ারদর ওঠানামা করে। আর এদেশের পুঁজিবাজারে ‘দৃশ্যমান কারণ’ না থাকলেও দর বাড়াকমা নিয়ে ‘গুঞ্জন’ থাকে। সেই গুঞ্জনের ওপর ভর করেই শেয়ারদর বাড়ে। আর অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে বারবার ক্ষতির শিকার হন সাধারণ বিনিয়োগকারী। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারদর বাড়ার কারণ খুঁজে পায় না। উল্টো কোম্পানির দেওয়া তথ্যে বিশ্বাস করে তাদের দেওয়া জবাব হুবহু প্রকাশের মাধ্যমে কোম্পানির বক্তব্যকেই ‘প্রচ্ছন্ন সমর্থন’ দেয় বা মেনে নেয়। অবশ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত। তাই কোম্পানি বা দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কী বললো আর বললো না, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। যে কারণে অস্বাভাবিক হলেও শেয়ারদর একটানা বাড়তে দেখলে ওই কোম্পানিতে তারা বিনিয়োগ করেন, যার পরিণতিতে ‘ফাটকাবাজ’দের খপ্পরে পড়ে ক্ষুদে বিনিয়োগকারীরাই পুঁজি হারান।
কিছু ক্ষেত্রে শেয়ারদর অনেক বেড়ে যাওয়ার পর কারণ খুঁজতে দায়িত্বশীলরা তৎপর হয়ে ওঠেন, ক্ষেত্রবিশেষে তদন্ত কমিটিও করা হয়। অন্যান্য তদন্ত প্রতিবেদনের মতো তদন্তের সময় দফায় দফায় বাড়ে। বিষয়টি আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া কিংবা বিনিয়োগকারীরা ভুলে যাওয়ার পর গোপনীয়তার মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তদন্ত প্রতিবেদন ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয় না কিছু। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও তদন্তের গ্যাঁড়াকলে শেয়ারদর কমে যায়। এতে আরও একবার ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা।
স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর ‘কারণ’ ছাড়া বাড়ার প্রবণতা ঠেকানোর দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোও এ দায় এড়াতে পারে না। তাই ‘কারণ ছাড়া শেয়ারদর বাড়ছে’- এমন তথ্য প্রচারের আগে নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা-স্বচ্ছতার স্বার্থে দায়িত্বশীলরা বিষয়গুলোয় নজর দেবেন। আর বিনিয়োগকারীরা সতর্ক থাকবেন। এমনটাই প্রত্যাশা।
গণমাধ্যমকর্মী
Add Comment