Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 8:27 am

কারসাজিতে আসক্তি বাড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর

শেখ আবু তালেব: সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধি পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকা এসব কোম্পানির সবগুলোই স্বল্প মূলধনির। স্বাভাবিক সময়ে এসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন তলানিতে থাকে। ক্রেতা সংকটে ভুগতে থাকা এসব শেয়ার এখন প্রায়ই বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় হল্টেড হচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা ২৬ ছাড়িয়েছে। সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকা এসব কোম্পানির ওপর ভর করেই গত সপ্তাহে সূচক বেড়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)।
পুঁজিবাজারের ট্যানারি খাতের কোম্পানি লিগ্যাসি ফুটওয়্যার। কোম্পানিটির বর্তমান প্রাইস আর্নিং বা পিই রেশিও হচ্ছে ৮৭ দশমিক ৩৩। বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানিটির গত সপ্তাহে ডিএসইতে গড়ে প্রতি ১০ কার্যদিবসে লেনদেন ১০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় শেয়ারদর বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫ শতাংশ। সর্বশেষ কার্যদিবসে তিন কোটি তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়। এক বছর পূর্বে ২৪ টাকা ৫০ পয়সায় থাকা শেয়ারটি এখন হাতবদল হচ্ছে ১০৯ টাকার বেশি দরে।
অথচ তৃতীয় প্রান্তিক শেষে (জুলাই ’১৭-মার্চ ’১৮) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৮ টাকা। যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের আলোচিত সময় ছিল শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ টাকা। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি লাভ-পরবর্তী মুনাফা করেছে এক কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ সময় বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে।
পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির প্রাইস আর্নিং বা পিই রেশিও যত কম, কোম্পানিটিকে ততই বিনিয়োগ উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ আশা করা যায়। অপরদিকে যে কোম্পানিটির পিই রেশিও যত বেশি, সেখানে বিনিয়োগ ততই ঝুঁকিপূর্ণ। পিই রেশিও ১৫ পর্যন্তকে স্বাভাবিক ও পিই রেশিও ২০ হলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। আর পিই রেশিও ৪০ হলে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে ওই কোম্পানির শেয়ারে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে মার্জিন ঋণ দেওয়া বন্ধের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বাজারে অস্বাভাবিক শেয়ার বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা আরেক কোম্পানি হচ্ছে মুন্নু জুট স্টাফলারস। পাঁচ হাজার ৭০৮ পিই রেশিও নিয়ে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকা কোম্পানিটির শেয়ারদর সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে শেয়ারটি তিন হাজার ৪৭৪ টাকার বেশি দরে হাতবদল হচ্ছে। বাজারে এর চেয়ে বেশি দামের শেয়ার নেই। শেয়ারটির দর গত চার মাসের ব্যবধানে ৫৭০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিন হাজার ৬২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
সর্বশেষ আর্থিক বছরে বিতর্কিত কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা দুই লাখ টাকায় নেমেছে। আর চলতি আর্থিক বছরের গত ৯ মাসের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে কোম্পানিটি। অথচ অর্থ সংকটের কারণে ধুঁকছে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিটি। ঋণখেলাপি হওয়া কোম্পানিটির নতুন কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেই। কারখানার দুটি ইউনিটের একটি এখনও বন্ধ রয়েছে মুন্নু জুট স্টাফলারসের।
চার হাজার ৫৬২ দশমিক ৮৬ পিই রেশিও নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে রয়েছে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ)। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে মাত্র সাত কোটি ৯০ লাখ টাকা।
অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে (জুলাই ’১৭-মার্চ ’১৮) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ টাকা, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের আলোচিত সময়ে ছিল শূন্য দশমিক ৯৯ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পাটির আয় কমেছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি লাভ কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে মাত্র ২৩ হাজার টাকা। ২০১০ সালে সর্বশেষ পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এরপর বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি লোকসানে থাকা কে অ্যান্ড কিউ।
কোম্পানিগুলোতে উচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকি রয়েছে জেনেও শেয়ার কিনছেন ক্রেতারা। কয়েক মাসের ব্যবধানে অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে ২৬টি ছাড়িয়েছে। নতুন কোনো বিনিয়োগ না থাকার পরও এসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহজে মুনাফা লাভের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে আসক্ত হয়ে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ক্রমেই এ আসক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বিনিয়োগকারীকেও জানতে হবে তিনি কোথায় বিনিয়োগ করছেন। লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারণ জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। তখন কোম্পানি বলেÑকোনো কারণ নেই। তখনই বিনিয়োগকারীদের বুঝতে হবে এখানে কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও অনেকে বিনিয়োগ করছেন, এর দায় তাদেরই নিতে হবে।
যদিও একইরকম চিত্র সম্প্রতি শেয়ারদর অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে থাকা অন্য সব কোম্পানির। দর বৃদ্ধির অস্বাভাবিক তালিকায় থাকা ওয়াটা কেমিক্যালের বর্তমান পিই রেশিও ৭৫ দশমিক ২২, ফার্মা এইডসের ৬১ দশমিক ৮৬, আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের ৭৩ দশমিক ৭১, বিডি অটোকারস লিমিটেডের ১৯৬ দশমিক ২৮, লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের ৮৭ দশমিক ৩৩, ওরিয়ন ইনফিউশনসের ৩৩ দশমিক ৭০, লিবরা ইনফিউশনসের ১৬৮ দশমিক ৩৭, রিজেন্ট টেক্সটাইলের ১৩ দশমিক ২১।
এছাড়া বস্ত্র খাতের সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের পাঁচ দশমিক ৯১, এইচআর টেক্সটাইল মিলসের ২৭ দশমিক ৪০। অপরদিকে ফু-ওয়াং ফুডসের ২৫ দশমিক ৭১, এপেক্স ফুডের ২৫৪ দশমিক ৮০, অ্যাম্বি ফার্মার ১৮৮ দশমিক ২০, স্টাইল ক্র্যাফটের ৭৯, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের ১৪২ দশমিক ১২, রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের ১৭২ দশমিক ৪২, মডার্ন ডায়িংয়ের ১৮৯ দশমিক ৫৩, কে অ্যান্ড কিউ’র চার হাজার ৫৬২ দশমিক ৮৬, আজিজ পাইপসের ৩১৪ দশমিক ৭৪, জেমিনি সি ফুডের ৭২ দশমিক ৯৭ ও সোনালী আঁশের ১৮৪ দশমিক ৬৬। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং লিমিটেড। তাদের পিই রেশিও হচ্ছে ১৬ দশমিক ৫৩।
এসব কোম্পানির শেয়ারদর এক বছরে ২০ থেকে ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারী। সাম্প্রতিক কয়েকটি স্বল্প মূলধনি ও তুলনামূলক কমসংখ্যক শেয়ারের কোম্পানি ঘিরেই সক্রিয় হয়েছে কারসাজিচক্র। এসব কোম্পানির শেয়ার হাতবদল ও দর বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করছে বাজারের সূচক। অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে কয়েকটি কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর চিঠিও দিয়েছে ডিএসই।
এর বিপরীতে সব কোম্পানিই জানিয়েছেÑদর বৃদ্ধির কোনো কারণ তারা জানে না। কোম্পানির কাছে দর বৃদ্ধির মতো প্রাইস সেনসেটিভ কোনো তথ্য নেই। তারপরও বিএসইসি পাঁচটি কোম্পানির দর বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আজিজ পাইপস, বাংলাদেশ ওয়েল্ডিং অ্যান্ড ইলেকট্রোডস, বিচ হ্যাচারি, ফু-ওয়াং ফুড, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড প্রভৃতি। এসবই স্বল্প মূলধনি কোম্পানি।