২০২১ সাল

কারসাজির শেয়ারেই সর্বোচ্চ রিটার্ন

শেখ আবু তালেব: ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করা কারসাজি চক্রের শেয়ারেই বছর শেষে সর্বোচ্চ রিটার্ন পেলেন বিনিয়োগকারীরা। বছরজুড়ে অস্বাভাবিক হারে শেয়ারদর বৃদ্ধিতে থাকা আলোচনায় থাকা শেয়ারের রিটার্ন সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ওটিসি মার্কেট থেকে ফেরা পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ারে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৫৮ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া গেছে।

অবশ্য সর্বোচ্চ দরে কেনা কয়েকটিতে বিনিয়োগ এখন লোকসান দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। কারণ হচ্ছে, সর্বোচ্চ শেয়ারদর বৃদ্ধিতে থাকা অবস্থায় কারসাজি চক্র বেরিয়ে গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য ও কোম্পানির দেয়া ডিভিডেন্ড বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। গবেষণালব্ধ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, ২০২১ সাল শেষে ডিএসইর বিভিন্ন খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগে রিটার্নের দিক দিয়ে শীর্ষে উঠে আসা অন্যগুলো হচ্ছেÑতমিজুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ই-জেনারেশন, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ফরচুন শুজ, এমারাল্ড অয়েল, সালভো কেমিক্যাল, জেনেক্স ইনফোসিস, কাট্টলী টেক্সটাইল, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, সি অ্যান্ড এ টেক্স ও বীকন ফার্মা।

কারসাজির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক ও রিটার্ন বেশি হওয়া প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু আহমেদ বলেন, ‘অহেতুক দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি খতিয়ে দেখতে পারে। সিন্ডিকেট করে এসব শেয়ার কেনা হয়েছে কি না, তা একমাত্র বিএসইসিই দেখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, বর্ধিত দামে কেনা এসব শেয়ার এখন বিনিয়োগকারী কার কাছে বিক্রি করবেন। সর্বশেষ যারা কিনেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কেন হবে?’

পুঁজিবাজারে শেয়ারের বাজার মূল্যের কারসাজি নিয়ন্ত্রণে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ভালো মানের শেয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন প্রবীণ এ শিক্ষক।

তথ্য বলছে, গত বছরজুড়ে কোম্পানির শেয়ারের বাজারদর ও ঘোষিত ডিভিডেন্ড হিসাব কষে এ রিটার্ন গণনা করা হয়েছে। যদিও কয়েকটি কোম্পানির ডিভিডেন্ড এখনও ঘোষণা করা হয়নি। আবার কয়েকটি তালিকাভুক্ত হয়েছে বছরের মাঝামাঝি সময়ে। কয়েকটি ওটিসি মার্কেট থেকে ফিরেছে মূল মার্কেটে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজির এসব শেয়ারের দর বৃদ্ধিও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখা যায়নি। আইনের ফাঁক গলিয়ে বেড়েছে এসব শেয়ারের দর।

তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন ওটিসি বাজারে থাকা পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ২০২১ সালের জুন মাসে। মূল মার্কেটে ফেরার সময়ে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছিল ১৭ টাকা ৬০ পয়সায়। লেনদেনের প্রথম দিন থেকেই শেয়ারদরে শুরু হয় উত্থান, যা চলে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত। ছয় মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির বাজারদর গত ৩০ ডিসেম্বর হয় ২১৬ টাকা ৮০ পয়সা। ছয় মাসের ব্যবধানে শেয়ারের বাজারদর বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ গুণ। এই সময়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। ছয় মাসে শেয়ারটি রিটার্ন দিয়েছে এক হাজার ৩৫৮ শতাংশ।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ওটিসি থেকে মূল মার্কেটে ফেরা আরেক কোম্পানি হচ্ছে তমিজুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস। এটিও গত বছরের জুন মাসে মূল মার্কেটে ফেরে। কোম্পানিটির বেলায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। ১৩ টাকা দরের শেয়ারটির বাজারদর বছর শেষে হয়েছে ১৬৩ টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে এ শেয়ারটিতে বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন পাওয়া গেছে এক হাজার ২৪০ শতাংশ। অর্থাৎ বিনিয়োগের বিপরীতে সাড়ে ১২ গুণের বেশি রিটার্ন পাওয়া গেছে।

তালিকায় থাকা অন্য কোম্পানি হচ্ছে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স। গত বছরে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ারদর ১০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বছরের শেষে লেনদেন হয়েছে ৭৭ টাকা ৩০ পয়সায়। বর্তমানে এটি ৮০ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। এ কোম্পানির শেয়ারে রিটার্ন পাওয়া গেছে ৬৭৩ শতাংশ। এছাড়া সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে রিটার্ন পাওয়া গেছে ৬০২ শতাংশ। এদিকে ই-জেনারেশনে ৪২৮ শতাংশ, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে ৩৫৪ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া গেছে।

এছাড়া ফরচুন শুজে রিটার্ন এসেছে ৩১৫ শতাংশ। বছরের শুরুতে ২২ টাকা ৬০ পয়সায় হাতবদল হওয়া শেয়ারটি শেষে বাজারদর দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকা ২১ পয়সা। এক বছরের ব্যবধানে শেয়ারের দর বেড়েছে ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে এ কোম্পানির শেয়ার। বিষয়টি বাজারে প্রচার হওয়ার পর থেকেই শেয়ারের দর বাড়তে থাকে। পুরো বছরজুড়েই শেয়ারটির দর বাড়তে থাকে। অথচ করোনার প্রভাবে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে কোম্পানিটির মুনাফা কমে অর্ধেকে নেমেছে। ২০২১ সালে কোম্পানির পণ্য রপ্তানি আদেশ এলেও করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের মুনাফায় যেতে পারবে না বলেই জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এরপর থাকা তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৮৪ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে ‘জেড’ ক্যাটেগরির এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ। পুঁজিবাজারে বিতর্কের জš§ দেয়া কোম্পানির মধ্যে আলোচিত এটি। বছরের শুরুতে শেয়ারটির দর ছিল ১০ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু বছর শেষেই তা হয়ে গেছে ৪১ টাকা ৫০ পয়সা। গতকাল লেনদেন হয়েছে ৪৪ টাকা ২০ পয়সায়। অথচ ২০১৬ সাল থেকে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে কোনো আর্থিক প্রতিবেদন দিচ্ছে না। একইসঙ্গে ২০১৬ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ ছিল কোম্পানিটির। বছরের শেষ দিকে উৎপাদনে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে মাত্র। তাও আবার পরীক্ষামূলক উৎপাদন। বাণিজ্যিক উৎপাদনের সক্ষমতায় যায়নি কোম্পানিটি। বাণিজ্যিক উৎপাদনের সক্ষমতায় ফিরলে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেতে থাকে গত বছরের শুরু থেকেই।

এরপরই রয়েছে সালভো কেমিক্যাল। কোম্পানিটিতে বিনিয়োগের রিটার্ন এসেছে ২৫৮ শতাংশ। পুঁজিবাজারে ২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারের বাজারদরেও এসেছে বড় পরিবর্তন। গত বছরের মে মাস থেকে শেয়ারের বাজারদরে উত্থান হয়। ৫৪ টাকা ৭০ পয়সার শেয়ারটি বছর শেষে মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে লেনদেন হয় ১৬৫ টাকা ৪০ পয়সায়।

গত বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারের বিপরীতে রিটার্ন এসেছে ২৩৭ শতাংশ।  যদিও ২০২০ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এর মধ্যে ১০ শতাংশই বোনাস।

এছাড়া কেলেঙ্কারির জš§ দিয়ে আলোচনায় থাকা কাট্টলী টেক্সটাইলের শেয়ারের বিপরীতে রিটার্ন এসেছে ২২৭ শতাংশ। নতুন আলোচনার জš§ দেয়া আনোয়ার গ্যালভানাইজিংয়ের শেয়ারে রিটার্ন দেখা গেছে ২২৩ শতাংশ, ডিএসইতে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে থাকা সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের শেয়ারের দরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বছর শেষে রিটার্ন দেখা গেছে ২১৭ শতাংশ।

২০১৬ সালের পর থেকে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের কোনো আর্থিক প্রতিবেদন দেখতে পাননি বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এই বাজারে সেই কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারদর বেড়েছে।

এছাড়া বীকন ফার্মার শেয়ারদর ৮১ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বছর শেষে হয়েছে ২৪৩ টাকা ৪০ পয়সা। এ শেয়ারে রিটার্ন দেখা গেছে ২১৭ শতাংশ। তালিকায় দশম স্থানে থাকা ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ারে রিটার্ন এসেছে ২১৩ শতাংশ। বছরের শুরুতে সাত টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটির দর বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০