কারাগারে ক্ষুদ্রশিল্প

পড়ালেখা ও খেলাধুলার পাশাপাশি কুটিরশিল্প, বাগান করা প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন নাটোর জেলা কারাগারের কয়েদিরা।
বিরক্তিকর সময় কাটানোর পরিবর্তে কর্মযজ্ঞে মেতেছে সশ্রম দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা। বাইরে গিয়ে যেন আর অপরাধ করতে না হয় সেই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাদের। নাটোর শহরের বড় হরিশপুর এলাকায় নাটোর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে চালু করা হয়েছে বন্দি প্রশিক্ষণ, সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। কেন্দ্রে চলছে বাঁশ দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরি ও সেলাইয়ের কার্যক্রম। রাজশাহী কারাগার থেকে বাঁশের রকমারি পণ্য তৈরির কৌশল রপ্ত করেছিলেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত শরিফুল ইসলাম ও হারুনর রশীদ। এই দুজনের কাছে কাজ শিখে নিয়েছেন নাটোর জেলা কারাগারের অসংখ্য কয়েদি। বর্তমানে এই কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন প্রায় ১৫ জন কয়েদি। তাদের হাতে তৈরি হচ্ছে মোড়া, কলমদানি, বাঁশের বেড ঝাড়– ও ছনের ঝাড়ু।
কয়েদিদের এ উদ্যোগ নিয়েছেন নাটোর জেলা কারাগরের জেল সুপার আবদুল বারেক। জানা গেছে, এই কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর গত ছয় মাসে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত এক লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে কারা সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত স্টল থেকে। কেন্দ্রের সেলাই কার্যক্রমও চলছে সমান গতিতে। জেলখানার দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিরা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে করতে এখন তাদের অনেকে প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। বন্দি সুজনের কাছ থেকে অন্যরা বেশি কাজ শিখেছেন, জানালেন ওয়ার্ডার ইকবাল।
নাটোর জেলা কারাগারে কর্মরত ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুই সেট করে ইউনিফর্ম তৈরি করেছেন তারা। সমাজসেবা বিভাগ থেকে দেওয়া ১৪টি সেলাই ও একটি ওভারলুপ মেশিনে কাজ চলছে। বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কম খরচে কারাগারের সেলাই কেন্দ্র থেকে পোশাক তৈরি করে নিতে পারবেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারাগার অভ্যন্তরের আঙিনায় তৈরি হয়েছে ফুল, ফল ও সবজির বাগান। আঙিনায় চাষ করা সবজির ডেটা প্রায় খাওয়ার উপযোগী। প্রস্তুতি চলছে শীত মৌসুমের সবজি চাষের। অর্ধশত আম, লিচু আর কাঁঠাল গাছ বন্দিদের মৌসুমি ফলের চাহিদা পূরণ করছে। বাগান তৈরি আর গাছের পরিচর্যায় বন্দিদের ভূমিকাই প্রধান।
কারা অভ্যন্তরে পরিচালিত হচ্ছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দুটি গণশিক্ষা কেন্দ্র। সপ্তাহের পাঁচদিনে শতাধিক শিক্ষার্থী এই কেন্দ্রে পাঠ নিচ্ছেন। যে বন্দি একেবারে নিরক্ষর হয়ে কারাগারে এসেছিলেন, গণশিক্ষা কেন্দ্র থেকে লেখাপড়া ও হিসাব করা শিখছে।
ধর্মীয় শিক্ষায় পিছিয়ে নেই এই কারাগারের বন্দিরা। প্রতিদিন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এবারের রমজানে সম্মিলিতভাবে কারাবন্দিরা ৪২টি কোরআন খতম দিয়েছেন বলে জানালেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আর কারা অভ্যন্তরের আটার মিলে কাজ করছেন কয়েকজন কয়েদি। ক্যারম, লুডু, দাবা, ব্যাডমিন্টন ও ভলিবল খেলায়ও আগ্রহ রয়েছে অনেকের। ওয়ার্ডগুলোয় রয়েছে টেলিভিশন। কারাগারের তিনজন বন্দি নিজেদের খরচে দৈনিক সংবাদপত্রও রাখছেন।
দণ্ডাদেশ ভোগ করে সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন শহরের বড় হরিশপুর এলাকার সোহরাব কাজির ছেলে আব্বাস কাজি। তিনি বলেন, কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে কারাগারে সময় ভালো কেটেছে, শরীর ও মন ভালো ছিল। কারাগারে ধর্মীয় পড়াশোনা, স্যারদের কথাবার্তা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। সদ্য কারাগার থেকে বের হওয়া নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর এলাকার কামাল শেখের ছেলে মাহাবুবুল শেখ বলেন, আর কখনও অন্ধকারের পথে চলব না, আমি এখন আলোর পথের যাত্রী।
নাটোর জেলা কারাগারের জেল সুপার আবদুল বারেক বলেন, কারাগারে কর্মরত সব কর্মী মানবতাবোধে উজ্জীবিত। সর্বোচ্চ মানবাধিকার সংরক্ষণ করে এর কার্যক্রম পরিচালনা করছি। বন্দিদের ওপর কোনো নির্যাতন করা হয় না এখানে। বরং কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে নিরন্তর প্রচেষ্টায় আমরা সচেষ্ট রয়েছি। কারাগারের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বন্দিদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। ফলে অনেকেই বন্দিদশা থেকে বের হয়ে সুপথে চলেন। কারাগারে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের সময় ভালো কাটে, শরীর ও মন ভালো থাকে। তারা দণ্ডাদেশের এক চতুর্থাংশ সময় রেয়াত পান বলে জানালেন এই কারা কর্মকর্তা।
নাটোরের ডিসি শাহিনা খাতুন বলেন, কারাগারের বন্দি জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে না দিয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলা ও বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত এবং উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাদের অপরাধপ্রবণ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ লক্ষ্যে নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

এমএম আরিফুল ইসলাম

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০