মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতোই বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নামে স্বতন্ত্র একটি সংস্থা আছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠান। আমরা যে কর্মমুখী শিক্ষার কথা বলি, এই বোর্ডই সেই কর্মমুখী শিক্ষা দেয়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কথা সবাই জানলেও এটির কার্যক্রম ও কী কী বিষয়ে পাঠদান করে, তা অনেকেরই অজানা এবং এটি অন্য বোর্ডগুলোর মতো আলোচিত না হওয়ায় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থী খুব বেশি পাওয়া যায় না, অথচ কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই বিশ্বের বহু দেশ তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেছে দারুণভাবে।
কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করে কোনো শিক্ষার্থীকেই বেকার জীবনযাপন করতে হয় না। কারণ কর্মদক্ষ চাকরি প্রার্থীদের চাহিদা বেশি দেশের শ্রমবাজারে। সরকারি চাকরি ব্যতীত বেসরকারি খাতে শুধু শিক্ষা দিয়ে সহজে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন কলেজভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে, তেমনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডও দেশব্যাপী নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কারিগরি শিক্ষার সুবিধা ও লাভজনক দিক হলো একই সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ এবং কর্মজীবনের জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স অন্যতম। এই কোর্সে ভর্তির যোগ্যতা যেকোনো স্বীকৃত বোর্ড থেকে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাস হতে হবে। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার/ ফিশারিজ/ লাইভস্টক/ ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন কমার্স ও সার্টিফিকেট ইন মেরিন ট্রেডকোর্স অন্যতম। এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (বিজনেস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি) পর্যায়সহ স্বল্পমেয়াদি অসংখ্য কোর্স বিদ্যমান। ওই কোর্সগুলোর মাধ্যমে দেশে বিদ্যমান সকল প্রকার কর্মক্ষেত্র, অর্থাৎ কৃষি, টেইলরিং, পোলট্রি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স, মৎস্য চাষ, কলকারখানায় কাজ, ডেইরি ফার্ম, কম্পিউটার টেকনোলজি-সহ বিদ্যমান সব কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা দেয়া হয়। এসএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষাক্রমের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন, বিজ্ঞান এবং খেলাধুলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, উচ্চতর গণিত, হিসাববিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশ, কৃষিশিক্ষা কার্যক্রম আছে, অর্থাৎ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কাজই হলো প্রয়োজনীয় শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলা।
বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশব্যাপী। এছাড়া বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউট, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভে ইনস্টিটিউটের অধীনে ডিপ্লোমা ইন সার্ভে কোর্স সম্পন্ন করে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। বেকারত্বের হার কমানোর মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখাকে শিক্ষার মূল গতিপথ হিসেবে দেখানো ও প্রচারের ফলে একজন শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমান পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হয়। এর মধ্যে যারা মেডিকেল, এলএলবি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সাংবাদিকতায় পড়ে, শিক্ষা কার্যক্রম শেষে তাদের একটা গতি হয়ে গেলেও যারা সাধারণ বিষয়ে পড়ে তাদের সরকারি চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। সরকারি চাকরিতে ব্যর্থ হলে বেসরকারি চাকরি কিংবা শিক্ষকতায় মনোযোগী হতে হয়, অন্যথায় বেকার জীবনযাপন করতে হয়। যাদের ব্যবসা করার মতো পুঁজি থাকে, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যবসায় নিয়োজিত হয়। তবে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি হওয়ায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অধিকাংশকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়, ফলে ভালো কোনো চাকরি না পেলে তাদের জীবন কঠিন হয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নতির জন্য কারিগরি শিক্ষা অতীব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার সুব্যবস্থা থাকলেও প্রচার ও প্রসার এবং পরিবারের অভিভাবকদের কারিগরি শিক্ষা নিয়ে বিশেষ ভাবনা না থাকায় খুব কমসংখ্যক নাগরিকই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে। অথচ এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস করেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমাসহ বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করা যায়, যার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ শেষে চাকরি কিংবা ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া সহজ হয়। কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে সরকারের আরও বেশি প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন। অপরদিকে সবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সবার জন্যই কর্মমুখী শিক্ষা জরুরিÑএই বিষয়টি অনুধাবন করে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত হওয়া সময়ের দাবি।
জুবায়ের আহমেদ
শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)
কাঁটাবন, ঢাকা