কার্যক্রম সম্প্রসারণ না হওয়ায় বাড়ছে অর্থ পাচার ও চোরাচালান

রহমত রহমান: দেশে প্রতিনিয়ত ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। ভ্যাট বিভাগের সর্বশেষ সম্প্রসারণ হয়েছে ২০১১ সালে। এরপর প্রায় এক যুগ পার হচ্ছে। এর মধ্যে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় বেড়েছে প্রায় কয়েক গুণ। এই এক যুগে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান বেড়েছে প্রায় ২০০ শতাংশ। কিন্তু নতুন ভ্যাট কমিশনারেট স্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাস্টমস সংক্রান্ত কার্যক্রমের আওতা বহুগুণে বাড়লেও নতুন কাস্টম হাউস স্থাপিত হয়নি কয়েক দশকেও। ফলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পূর্ণাঙ্গ কায়িক পরীক্ষা করতে পারছে না। বর্তমানে গড়ে মাত্র ১০ শতাংশও চালানের পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। এতে চোরাচালান, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও রপ্তানি এবং পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগে কাজ করেন কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রতি বছর তাদের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় বেড়েই চলেছে। অথচ কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের আওতা সম্প্রসারণ না হওয়ায় পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন কর্মকর্তারা। এতে তাদের মনোবল নষ্ট হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে। ইতোমধ্যে নতুন চারটি কাস্টম হাউস ও পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেট স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত ফাইল বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আটকে আছে। এছাড়া ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে দুই ভাগ করার অনুমোদনের ফাইলও আটকে রয়েছে। এসব বিষয় দ্রুত সুরাহা হলে এ বিভাগের কার্যক্রম অনেকটা সম্প্রসারিত হতো বলে তারা জানান।

কর্মকর্তারা বলছেন, ১০০ টাকার পরোক্ষ কর (কাস্টমস ও ভ্যাট) আদায়ে প্রশাসনিক ব্যয় হয় ১৭ পয়সা। আর মোট রাজস্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আদায় করে এই দুই বিভাগ। অথচ এই দুই বিভাগের সম্প্রসারণ হয় না। আবার ৩১তম বিসিএসের পর শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে কোনো সহকারী কমিশনার নিয়োগ হয়নি। মূলত পদায়নের জায়গা না থাকায় বিসিএস থেকে সহকারী কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ করা হয়নি। তবে দুই বিভাগের সম্প্রসারণ না হওয়ায় পদোন্নতিতে (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) জট তৈরি হয়েছে। দুই বিভাগের দ্রুত সম্প্রসারণ হলে একদিকে রাজস্ব আদায় কয়েকগুণ বাড়বে, অন্যদিকে পদোন্নতির জটলা নিরসন হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ ৩১তম বিসিএসে শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারে সহকারী কমিশনার হিসেবে ৯৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ৯৮ জনের মধ্যে ৯১ জন যোগদান করেন। নিয়ম অনুযায়ী ৫ বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালে তাদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু ৯ বছর (২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) অতিবাহিত হওয়ার পরও তারা পদোন্নতি পায়নি। কারণ কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সম্প্রসারণ না হওয়ায় পদোন্নতি দিয়ে পদায়নের জায়গা ছিল না। পদোন্নতি না পাওয়ায় কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ তৈরি হয়। কর্মকর্তারা সারাদেশে একযোগে ভ্যাট ও কাস্টমস কমিশনারদের মাধ্যমে স্মারকলিপি দেয়। এছাড়া কর্মকর্তারা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। এই অসন্তোষ নিরসনে এনবিআর তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি দিতে ৫৩টি উপকমিশনারের ‘সুপারনিউমারারি’ পদ সৃষ্টি করে। পরে ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর ৮৪ জনকে উপকমিশনার হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

কর্মকর্তারা বলছেন, ৩১ ব্যাচের এসব কর্মকর্তা যে সময় যুগ্ম কমিশনার হওয়ার যোগ্য হয়েছেন; সে সময়ে পদোন্নতি পেয়েছেন উপকমিশনার হিসেবে। অর্থাৎ তাদের জীবন থেকে বাড়তি চার বছর হারিয়ে গেছে। মূলত ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগের সম্প্রসারণ না হওয়ায় পদোন্নতি জটিলতা তৈরি হয়েছে।

দুই বিভাগের কর্মকর্তাদের হিসাব মতে, ৩২ থেকে ৪০ পর্যন্ত বিসিএসে শুল্ক ও আবগারি কোনো ক্যাডার নিয়োগ হয়নি। মূলত পদ খালি না থাকায় এনবিআর এসব বিসিএস থেকে দুই বিভাগের জন্য কোনো ক্যাডার কর্মকর্তা নিতে পারেনি। যার ফলে দুই বিভাগে মেধাবীরা আসতে পারেনি। দুই বিভাগের ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তারা সহকারী কমিশনার থেকে পদোন্নতি পেয়ে উপকমিশনার হয়ে গেছেন। ফলে দুই বিভাগে আর সহকারী কমিশনার নেই বললেই চলে। সহকারী কমিশনারের কাজ করতে হচ্ছে উপকমিশনারদের। ৪০তম বিসিএস থেকে সম্প্রতি ৭২ জন সহকারী কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা এখনো যোগ দেননি।

অপরদিকে, ৪১তম ব্যাচের শুল্ক ও আবগারি ক্যাডার পদের নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হতে ২০২৩ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এ অবস্থায় ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত শুল্ক ও আবগারি ক্যাডার না নেয়ার ফলে আগামীতে শুল্ক ও আবগারি দপ্তরে নেতৃত্ব সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ ৩১ ব্যাচের অনেকেরই বয়স কমিশনার বা সদস্য হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। যারা ৪১-এর মাধ্যমে নতুন যোগদান করবেন তাদের কমিশনার বা সদস্য হওয়ার যোগ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় চাকরিকাল হবে না বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের একাধিক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, উন্নয়নের মূলমন্ত্র রাজস্ব। সেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এনবিআরের ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়করের অফিস সম্প্রসারণ, জনবল নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন কাস্টম হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেট স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এনবিআর থেকে প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরে তা সংশোধন করে জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন থেকে আরও কিছু সংশোধনের জন্য তা আবারও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ফেরত পাঠানো হয়। বর্তমানে সেই প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত তা আবার জনপ্রশাসনে পাঠানো হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০