নিজস্ব প্রতিবেদক: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থা সদস্যদের দ্বারা ‘জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে’ গঠিত তদন্ত কমিশন এখনও কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কমিশনের কার্যালয় প্রস্তুত না হওয়ায় সদস্যরা সবাই একসঙ্গে বসতেও পারেননি।
সরকার গত ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিশন গঠন করে। কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা দেয়ার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত বৃহস্পতিবার কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে এ কমিশনকে তদন্ত শেষ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে ৪৫ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের জন্য কার্যালয় প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় জনবল দেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান গত শুক্রবার বলেন, কমিশনের জন্য গুলশানে একটি অফিস ঠিক করা হয়েছে। সেটি গণপূর্ত বিভাগের। অফিস গোছানোর কাজ চলছে। তিনি বলেন, রোববার কমিশনের প্রথম বৈঠক করার চেষ্টা চলছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেনÑহাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্তে এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
কমিশনের এই কার্যপরিধিকে আরও স্পষ্ট করা এবং এর ব্যাপ্তি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। এই কমিশনের মূল কাজ হওয়া উচিত গুমের পরিকল্পনা, নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কমিশনের একাধিক সদস্য বলেন, কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনার চিন্তা রয়েছে। কর্মপরিধি বাড়িয়ে কীভাবে গুমের সামগ্রিক চিত্র এবং এর নেপথ্যের কারিগরদের শনাক্ত করা যায়, সেটি নিয়েও তারা কাজ করতে চান। শেখ হাসিনা সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কারও লাশ পাওয়া গেছে, কেউ কেউ গোপন বন্দিশালা থেকে অনেক দিন পর ফিরে এসেছেন। অনেকে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরদিন ৬ আগস্ট প্রায় আট বছর পর গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা।
গুমের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিল। শেখ হাসিনা সরকার সেটা আমলে নেয়নি। উপরন্তু গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন সময় উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়েছেন ওই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও ব্যক্তিরা।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও বিচার পাননি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে। এরপর ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া বার্তায়ও ‘গুম সংস্কৃতির’ সমাপ্তি ঘটানোর অঙ্গীকারের কথা বলা হয়। আয়নাঘর নামে পরিচিতি পাওয়া গোপন বন্দিশালাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।