কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের করণীয়

নাসির উদ্দিন খোন্দকার: গাইবান্ধার ১৩ বছরের মেয়ে অনুফা (প্রকৃত নাম নয়)। সে স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। মাসিক চলাকালে ২-৩ দিন ধরে প্রচুর রক্তক্ষরণ এবং তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথায় স্কুলে যেতে পারছে না। মাসের এ বিশেষ সময় রক্তক্ষরণ এবং ব্যথা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, কয়েকদিন পর এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে বলে তার মা তাকে বলেছে। মাসখানেক পর আবার মাসিক চলাকালে একইরকম প্রচুর রক্তক্ষরণ এবং তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয় তার। মাসিক চলাকালে সে ঘরের বাইরেই বের হতে পারে না। তার মা-বাবা কেউই ততটা শিক্ষিত নয়। তাই এ ব্যাপারে তারা মোটামুটি উদাসীন। তারা বুঝতেই পারে না, এটা মাসিক চলাকালে ব্যথা নাকি, অন্য কোনো রোগ। ঋতুস্রাব শুরুর আগে অল্পস্বল্প পেট ব্যথা প্রায় সবারই হয়। পলিসিস্টিক ওভারি হলে তাতে সিস্ট থাকবেই। তবে এই সিস্টগুলো খুব একটা সমস্যা তৈরি করে না। কিন্তু সিস্টগুলো যদি রক্তে পরিপূর্ণ হয়, তাহলে এন্ডোমেট্রিওসিস নামক রোগের সূত্রপাত হয়।

জরায়ু বা ইউটেরাসের এক প্রয়োজনীয় একটি আবরণ হলো এন্ডোমেট্রিয়াম। বয়ঃসন্ধির সময় থেকে সন্তান ধারণের সময়কালে মেয়েদের জরায়ু বা ইউটেরাসের নানা পরিবর্তন ঘটে। ঋতুস্রাবের পর জরায়ুর মধ্যে থাকা এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি ক্রমেই পরিপূর্ণতা পায়। এ সময়ে গর্ভবতী না হলে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি জরায়ু থেকে ছিঁড়ে পড়ে যায়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণটি জরায়ু থেকে খসে পড়ে গেলেই মাসিক বা ঋতুস্রাব শুরু হয়। এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত রোগীর জরায়ুর ভেতর ছাড়াও এর বাইরের দিকে যেমন ডিম্বাশয় বা ওভারিতে, ডিম্ববাহী নালি বা গর্ভনালি বা ফেলোপিয়ান টিউব;  এমন কি কখনও কখনও রেক্টাম বা মলাশয়ের গায়ে এন্ডোমেট্রিয়াম আবরণ তৈরি হয়। ঋতুস্রাবের সময় জরায়ুর বাইরের দিকের এসব অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুগুলোও ছিঁড়ে যায়। ফলে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আর এ কারণেই এ সময় তলপেটে অসহ্য ব্যথা করতে থাকে। রক্তক্ষরণের ফলে ওভারির ভেতরে রক্ত জমে যে সিস্ট তৈরি হয়, তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘চকোলেট সিস্ট’ (ঈযড়পড়ষধঃব ঈুংঃ বা ঙাধৎরধহ ঊহফড়সবঃৎরড়সধ) বলা হয়। অজ্ঞতা এবং অবহেলার ফলে অনেক সময় ডিম্বাশয়েও জরায়ুতে এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে টিউমারও হতে পারে। 

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রচারণা, সরকারি নীতিতে এ বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা, উন্নততর সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং কমিউনিটির ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের পাশে থাকতে কিছু সংগঠন কাজ করছে। যৌবনে পদার্পণকারীদের জন্য সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা এবং বিশেষ কিছু জেলায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্যও কাজ করা হচ্ছে।

প্রজনন অঙ্গ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সুস্থ ও সঠিক ধারণা থাকলে তা একজন কিশোর-কিশোরীর মানসিক গঠনে সাহায্য করে; তবে বাংলাদেশের সমাজে যুগ যুগ ধরে চলা জড়তার কারণেই প্রজšে§র পর প্রজš§ বিজ্ঞানসম্মত কোনো জ্ঞান ছাড়াই পার করছে। সামাজিক অস্বস্তি ও জড়তার কারণেই প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলতে তারা সংকোচ বোধ করেন। ফলে বিদ্যমান সমস্যা তীব্রতর হয়ে এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, প্রজনন স্বাস্থ্য হচ্ছে জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রজননতন্ত্র সম্পর্কীয় একটি পরিপূর্ণ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণের সামগ্রিক ব্যবস্থা। প্রজনন স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় একজন মানুষ সন্তোষজনক ও নিরাপদ যৌন জীবনযাপন করতে পারবে এবং প্রজননে সক্ষম হবে এমন জ্ঞানকে বোঝায়।

পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, আরটিআই/এসটিআই ও এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গর্ভপাত প্রতিরোধ ও গর্ভপাতজনিত জটিলতার ব্যবস্থাপনা, যৌন স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা, পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য ও তাদের অংশগ্রহণ, স্তন ও প্রজননতন্ত্রের ক্যানসারসহ অন্যান্য স্ত্রীরোগের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং বন্ধ্যত্ব ও অন্যান্য যৌন সমস্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ।

বাংলাদেশে রয়েছে তিন কোটি ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরী। বয়ঃসন্ধি এমন একটা পর্যায় যখন একটি শিশু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করে। এ সময়ই মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা তৈরি হয়। এই সময়ে ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে, যে কারণে তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হয় এ সময়টায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বিকাশের সুযোগ করে দেয়ার মতো নীতি গ্রহণ করা গেলে এই ছেলে-মেয়েরা দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতার চক্র ভেঙে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের তিন কোটি ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরীর এদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। তারপরও তাদের উপযোগী করে সেবার ব্যবস্থা করার চিন্তা এখনও ততটা গুরুত্ব পায় না। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। শিশু বিয়ের উচ্চ হারের কারণে বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালেই অনেক মেয়ে গর্ভধারণ, সহিংসতা ও অপুষ্টির ঝুঁঁকিতে থাকে। বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগে। এ বয়সের ছেলে-মেয়ে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে অনেক।

প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক ও সামাজিক বিষয়ে কাউন্সেলিং ইত্যাদির মতো বিষয়ে তারা অবগত নন। এই অবস্থার কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু রোগাক্রান্ত হন। বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালের তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনই রুগ্ণ। আর মেয়েদের ১১ শতাংশই অনেক বেশি অপুষ্টির শিকার। তাদের অধিকাংশেরই জিংক, আয়োডিন ও আয়রনের মতো অনুপুষ্টির ঘাটতি রয়েছে।

বৈশ্বিকভাবে দেখা গেছে, পরিণত বয়সের মায়ের গর্ভে সন্তানের মৃত্যুর ঘটনার দ্বিগুণ ঘটে ২০ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ২০ বছরের কম বয়সী মায়েদের প্রতি হাজার শিশুর জš§দানে ৩১ জনের মৃত্যু হয়। ২০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের গর্ভধারণ বা সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুর ঘটনার দ্বিগুণ ঘটে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে, এই হার ৫ গুণ হয় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য নীতিতে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, তাদের প্রতি সহিংসতা রোধ এবং কিশোরী মায়েদের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা এ-সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রমের একটি অংশে পুষ্টি, এইচআইভি, পয়ঃনিষ্কাশন, ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা, জীবন দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা এবং গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের মতো বিষয়ও রয়েছে। প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীরাও যাতে এসব সেবা পায়, সে বিষয়টিও এখানে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

ইউনিসেফ এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে দুই ভাবে সহায়তা করে। প্রথমত, সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় যেমন, নীতি সংশোধন, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং কর্মসূচি তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে সরকারকে সহায়তা করা হয়। দ্বিতীয়ত, যেসব জেলায় শিশু বিয়ের হার অনেক বেশি, সেসব জেলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেশের মধ্যে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে ইউনিসেফ। কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার আছেন, তাদের দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। এ গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনিসেফ সেবা দাতা ও সামনের কাতারের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে সরকারের সঙ্গে। এছাড়া স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ, হাত ধোয়ার জায়গায় সাবান রাখা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রচারপত্র প্রভৃতি বিষয় যাতে ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয় এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা থাকে, সে জন্য সরকার ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে ইউনিসেফ। এছাড়া প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা, বিতরণ এবং তা তদারক করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও কাজ করছে ইউনিসেফ সরকারের সঙ্গে।

পাঠ্যপুস্তকে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবামূলক বিষয় পড়ানোর সমস্যা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ধারণা দেয়া আছে। তবে ক্লাসে শিক্ষকরা অনেকেই বিষয়টি পড়াতে অস্বস্তি বোধ করেন। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে পরিবার থেকে শেখানো হবে, নাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিখবে, সেটা নিয়ে যেমন বিতর্ক এবং অস্বস্তি রয়েছে, তেমনি প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে শেখার ফলে ছেলে-মেয়েদের লাভ হবে, নাকি উল্টো ক্ষতি হবে সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে।

তবে এটা সত্য যে, আমরা প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো মানবজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইসু্যুকে নানাভাবে অবজ্ঞা করছি, যা লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ধ্বংস করছে। সচেতনতাই এ ক্ষেত্রে অনেক জীবন বাঁচাতে পারে এবং ভালো সমাধান দিতে পারে। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে যদিও পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমাদের দেশে কিছু বাধা আছে; ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতিগত এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা যেতে পারে। শুধু সরকারই নয়, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমোদেরও এই ইস্যুতে কথা বলতে হবে আমাদের। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং এসডিজি বাস্তবায়নে প্রজনন স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রেই তা বিশাল ভ‚মিকা রাখবে, সন্দেহ নেই। প্রয়োজন শুধু নাগরিকদের সচেতনতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং এগিয়ে আসা।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০