Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 6:59 pm

কীভাবে আয়করের পরিমাণ কমাবেন

কামরুল হাসান নূর : সরকারের রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস আয়কর। প্রতি বছরই করের জাল বিস্তৃত হচ্ছে এবং রিটার্ন জমার বাধ্যবাধতা বাড়ছে। বর্তমান আইনে সরকারি প্রায় সব ধরনের সেবা ও ব্যাংকিং সেবার জন্য রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিল (পিএসআর) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে আয়ের বিপরীতে করের টাকাও জমা দিতে হচ্ছে। কিন্তু করদাতা যদি আগে থেকেই কর পরিকল্পনা করতে পারেন তাহলে তার প্রদেয় করের পরিমাণ বেশ কিছুটা কমাতে পারবেন। সরকার করদাতাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে নির্দিষ্ট কয়েকটি খাতে বিনিয়োগে কর রেয়াত বা কর ছাড়ের সুবিধা দিয়ে থাকে। একজন ব্যক্তিগত করদাতা যদি তার কর অর্থবছরে সেসব খাতে বিনিয়োগ করেন তাহলে তার এক দিকে যেমন সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় আবার প্রদেয় করের পরিমাণও হ্রাস করা সম্ভব হয়। তবে এর জন্য অবশ্যই দরকার কর পরিকল্পনা। বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা নিতে হলে একজন করদাতাকে কর অর্থবর্ষ, করবর্ষ ও বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতের খাতগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।

কর অর্থবর্ষ বলতে আয়কর আইনে কী বোঝায়? কর অর্থবর্ষ বলতে যে বর্ষে রিটার্ন জমা দেবেন তার পূর্ব বর্ষের ১ জুলাই থেকে রিটার্ন জমা দেয়ার বর্ষের ৩০ জুন সময়কাল। অর্থাৎ বর্তমান রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য আমাদের অর্থবর্ষের সময়কাল হচ্ছে, ১ জুলাই ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত। আর বর্তমান করবর্ষ হবে, ২০২২-২০২৩। করবর্ষ ২০২২-২০২৩ এর রিটার্নে বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নিতে হলে করদাতাকে অবশ্যই অর্থবর্ষ ২০২১-২০২২-এর ভেতর বিনিয়োগ করতে হবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করব? করদাতা তার নিজের বা স্বামী/স্ত্রী বা সন্তানের নামে জীবন বিমা করতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো এক কর অর্থবর্ষে তার জমাকৃত বিমা প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিমামূল্যের ১০ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি আপনার বিমামূল্য হয় ১০ লাখ টাকা তাহলে আপনি ১০ লাখ টাকার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত এক অর্থবর্ষে জীবনবিমা খাতে কর রেয়াতের জন্য বিনিয়োগ দেখাতে পারবেন।

এছাড়া সরকারি কর্মকর্তার প্রভিডেন্ড ফান্ডে চাঁদা, (তবে এই চাঁদার পরিমাণ বেতনের এক-পঞ্চমাংশের বেশি নয় ), স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তা ও করদাতার চাঁদা, কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বিমা তহবিলে চাঁদা, সুপার এনুয়েশন ফান্ডে প্রদত্ত চাঁদা; বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা পায়ার জন্য গণ্য হবে।

সরকার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীকে কর রেয়াতের সুবিধা প্রদান করে। বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার, স্টক, মিউচ্যুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ করলে ওই অর্থবর্ষে বিনিয়োগকৃত অর্থের ওপর কর রেয়াত সুবিধা প্রদান করা হয়।

যেকোনো তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট পেনশন স্কিমে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০,০০০ টাকা বিনিয়োগ, সঞ্চয়পত্র ক্রয় এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগেও কর রেয়াত সুবিধার আওতাভুক্ত। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ওপর কর রেয়াত দাবি করলে করদাতাকে অবশ্যই সেই সঞ্চয়পত্র মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়ন করা যাবে না। যদি কর রেয়াত দাবি করা সঞ্চয়পত্র করদাতা সঞ্চয়পত্রে মেয়াদপূর্তির আগেই নগদায়ন করে ফেলে, তাহলে তাকে কর রেয়াত দাবিকৃত টাকা এবং সেই টাকার ওপর বকেয়া করের যে জরিমানা ধার্য হয় তা দিতে হবে। তাই ভুলক্রমেও সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির আগে নগদায়ন করবেন না।

উপরিউক্ত বিনিয়োগ খাতগুলো ছাড়াও করদাতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত নির্দিষ্ট খাতে অনুদানের বিনিময়ে কর রেয়াত সুবিধা নিতে পারবেন। যার অন্যতম খাত হচ্ছে, জাকাত তহবিলে দান। মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ইসলামি নিয়ম অনুসারে সম্পদের ওপর জাকাত প্রদান করে থাকেন। করদাতা যদি এই জাকাতের টাকা জাকাত ফান্ড অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ দ্বারা গঠিত জাকাত ফান্ডে প্রদান করেন তাহলে তিনি সেই জমাকৃত টাকার ওপর কর রেয়াত সুবিধা নিতে পারবেন।

এছাড়া আর যেসব অনুদান কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে তা হলো জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান অনুদান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানে অনুদান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত কোনো দাতব্য হাসপাতালে দান, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানে দান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদত্ত দান, আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কে দান, ঢাকা আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে দান, আইসিডিডিআর,বি ওতে প্রদত্ত দান, সিআরপি সাভারে দান, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত জনকল্যাণমূলক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশে দান।

কর রেয়াতের জন্য অনুমোদনযোগ্য অঙ্ক হচ্ছে; রেয়াতযোগ্য খাতে করদাতার বিনিয়োগ/চাঁদার পরিমাণ, করযোগ্য মোট আয়ের ২০ শতাংশ (৮২ঈ ধারার (২) ধারায় বর্ণিত উৎসগুলো থেকে প্রাপ্ত আয় এবং কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত বা হ্রাসকৃত করহার প্রযোগ্য এমন আয় থাকলে তা ব্যতীত), ১ কোটি টাকা; এই ৩টির ভেতর যেটি কম হবে সেই অনুমোদনযোগ্য অঙ্কের ১৫ শতাংশ হারে কর রেয়াতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে। এই বিনিয়োগ কর রেয়াত দাবি করতে হলে মূল রিটার্নের সঙ্গে বিনিয়োগ কর রেয়াত-সংক্রান্ত তফসিল দাখিল করতে হবে।

কর রেয়াত ছাড়াও আর কয়েকটি সাধারণ বিষয় আছে যেগুলো রিটার্ন তৈরির সময় বিবেচনায় আনলে করের পরিমাণ কমানো যায়। যেমনÑকরদাতার উৎসে কর কর্তন। চাকরিজীবীদের আয় করযোগ্য হলে প্রতিষ্ঠান থেকেই উৎসে কর কর্তন করে থাকে। তাই রিটার্ন তৈরির সময় প্রতিষ্ঠান থেকে উৎসে কর কর্তনের প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে উৎসে কর্তিত কর প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। এছাড়া ব্যাংক সুদের বিপরীতে উৎসে কর কর্তন, গাড়ির ফিটনেস নবায়নকালে অগ্রিম কর, সেবামূল্যের পরিশোধের সময় যে উৎসে কর কর্তন করা হয়েছিল সেই সবও করদাতার প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়।

অনেক সময় করদাতার জমাকৃত করের পরিমাণ ওই বছরের প্রদেয় করের থেকে বেশি থাকে, যা পরবর্তী করবর্ষের প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। এই ফেরতযোগ্য করের সমন্বয়ের সময়ে রিটার্নে যে করবর্ষের কর ফেরত দাবি সমন্বয় করছেন তা উল্লেখ করে দিতে হবে।

দেখা যায়, অনেক করদাতার রিটার্নে আয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকে না বা পারিবারিক খরচের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা রিটার্নে উল্লেখ করেন না। যার ফলে, উপকর কমিশনার তার আয়ের সামঞ্জস্যে পারিবারিক খরচ বৃদ্ধি করে দেন যা রিটার্নে আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। তাই করদাতারা যদি আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রেখে রিটার্নে পারিবারিক খরচের পরিপূর্ণ ব্যাখা প্রদান করেন তাহলে অতিরিক্ত আয়ের দায় থেকে ঝুঁঁকিমুক্ত থাকতে পারেন।

এছাড়া অনেক করদাতার নিট সম্পদের পরিমাণ তিন কোটির নিচে কিন্তু নিজ নামে একাধিক মোটর গাড়ি থাকার কারণে সারচার্জের আওতায় পড়ে যান। তাই যদি সম্ভবপর হলে, নিজ নামে একটির বেশি গাড়ির মালিকানা নিবন্ধন না করে পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে গাড়ির মালিকানা নিবন্ধন করে সারচার্জ আওতামুক্ত থাকতে পারেন।

একজন সাধারণ করদাতা নিজে অথবা আয়কর আইনজীবীর সহায়তায় রিটার্ন তৈরি করার সময় উপরিউক্ত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি সংযুক্ত করে করের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারেন। যারা এই করবর্ষে বিনিয়োগযোগ্য কর রেয়াতের খাতে বিনিয়োগ না থাকার কারণে কর রেয়াতের সুযোগ নিতে পারবেন না তারা আজ থেকেই আপনার জন্য সুবিধাজনক বিনিয়োগ খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে পারেন, যাতে এই বছরে সম্ভবপর না হলেও আগামী বছরে যেন কর রেয়াতের সুবিধাটা নেয়া যায়।

আয়কর পরামর্শক