কী হবে চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ?

তাজুল ইসলাম : চামড়াশিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। পোশাকশিল্পের পরে বাংলাদেশে চামড়াশিল্পের স্থান। চামড়াশিল্পের ওপর ভর করে বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৯ লাখ মানুষ জীবিকানির্বাহ করে। বাংলাদেশে ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারি স্থাপিত হয়। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় মোট ৩০টি ট্যানারি ছিল। ১৯৭০ সাল থেকে চামড়াশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা ২৩০টির বেশি, যার অধিকাংশ ঢাকায় অবস্থিত।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শিল্প খাত হলেও ২০১৩ সাল থেকে শিল্পটি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে। ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ১২৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। তার পরবর্তী সময় তিন অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল যথাক্রমে ১১৩, ১১৬ ও ১২৩ কোটি ডলার। বুড়িগঙ্গাকে দূষণ থেকে বাঁচাতে ২০১৭ সালে হাজারিবাগ থেকে সরিয়ে সাভারে ট্যানারি শিল্প এলাকা স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে নতুন কারখানা স্থাপন ও পুরোদমে উৎপাদনে যেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। ঠিক সময়ে পণ্যের সাপ্লাই দিতে না পারায় অনেক বিদেশি ক্রেতা হাতছাড়া হয়ে যায়।

সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারায় ২০১৭ সাল থেকে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ওপর নিয়মিত বড় অঙ্কের আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে গিয়ে ৭৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

২০১৩ সালে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ছিল ৮৫-৯০ টাকা, যা ২০২০ সালে এসে নেমে যায় ৩৫-৪০ টাকায়। কাঁচা চামড়ার বার্ষিক জোগানের প্রায় অর্ধেকের বেশি আসে পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানির পশু থেকে। ২০২১ সালে দাম কিছুটা বেড়ে প্রতি বর্গফুট ৪৫ টাকা হলেও বাজারে চামড়ার ক্রেতা ছিল না। সামান্য কিছু চামড়া মাদরাসাগুলো সংগ্রহ করলেও বেশিরভাগ চামড়া মাটিচাপা দিতে বাধ্য হয়েছে সাধারণ মানুষ। এতে করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব। গত বছর কোরবানি ঈদে করোনা সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় দেশে দফায় দফায় লকডাউন দেয়া হয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এবার ঈদে করোনা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যান্য দেশে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করায় রপ্তানিতে তার তেমন প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। এবার চামড়ার ভালো দাম পাওয়া নিয়ে আশাবাদী সবাই। এবার চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। ট্যানারি মালিকদের ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া কিনতে হবে ৪৭-৫২ টাকায়, যা গত বছরের তুলনায় তিন থেকে সাত টাকা বেশি। আমাদের দেশের চামড়াশিল্প একটি রপ্তানিমুখী শিল্প। গবাদিপশুর চামড়ার মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশি হয়ে থাকে শুধু কোরিয়া, হংকং ও চীনে। চীনে করোনা মহামারি দেখা দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পে বড় একটি ধস নামে। দেশে কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্য দেশগুলোয় রপ্তানিও বন্ধ। তারা চামড়া আমদানি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দেশের ৯০ শতাংশ ট্যানারি ঢাকায় হওয়ায় ঈদেও পর অল্প সময়ে কাঁচা চামড়া ঢাকার ট্যানারিতে স্থানান্তর করাও অনেকটা অসম্ভব ছিল। অনিশ্চয়তার কারণে তাই এবার মাঠপর্যায়ে চামড়া ক্রেতাদের তেমন দেখা মেলেনি। আর চামড়া সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে সাধারণ মানুষ চামড়া সংরক্ষণ করতে পারে না, ফলে অনেক চামড়া পচে যায়, বা গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। আর ট্যানারিগুলো মূলত শহরাঞ্চলে অবস্থিত, তাই গ্রাম অঞ্চল বা উপজেলাভিত্তিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ক্রেতার অভাবে অধিকাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে এ দেশে রয়েছে দুই কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার মিলিয়ন গরু, আট লাখ ৩০ হাজার মহিষ, এক কোটি ৪৮ লাখ ছাগল, ১৯ লাখ ভেড়া, যা নিঃসন্দেহে একটি অনেক বড় সংখ্যা। দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে প্রতিদিন অনেক গরু-ছাগল জবাই হয়, যা পর্যাপ্ত চামড়ার জোগান দেয়।

চামড়াশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। পোশাকশিল্পকে যেভাবে বড় করে দেখা হয়, চামড়াশিল্পকে সেভাবে দেখা হয় না। চামড়াশিল্পের এই অধঃপতন ঠেকাতে সরকারের হস্তক্ষেপ অতীব জরুরি। চামড়া রপ্তানির ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে চামড়াজাত পণ্যের কারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে যেমন কর্মসংস্থান হবে, তেমনি হবে চামড়ার যথাযথ ব্যবহার। চামড়া সংরক্ষণে লবণের জোগান নিশ্চিত করা এবং ভর্তুকি প্রদান, উপজেলা পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যে শিল্পনগরী তৈরি করা এবং চামড়ার নতুন বাজার তৈরির মাধ্যমে চামড়াশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। চামড়াশিল্পের প্রতি এখনও সুদৃষ্টি দেয়া না হলে পাটশিল্পের মতো সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পকেও আমাদের হারাতে হবে।

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০