কুইক রেন্টালে বিনিয়োগের ৪৫০% ক্যাপাসিটি চার্জ!

বিদ্যুৎ খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি বিশেষ অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই দ্রুত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে ছোট ও মাঝারি বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হলেও তা চলেছে আট থেকে ১০ বছর। কোনোটি চলেছে আবার ১২ থেকে ১৫ বছর। এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় অতি উচ্চ হারে। এতে বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চারগুণ বা ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ তুলে নিয়েছে কোনো কোনো কোম্পানি।

শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমনই কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ঘোড়াশালে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের নির্মিত ১৪৫ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক (গ্যাস ও ডিজেল) বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট। প্রথমে ডিজেলে ১৮ মাস চললেও পরে তা গ্যাসে উৎপাদন শুরু করে। উৎপাদন শুরুর সময় কুইক রেন্টাল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি কিলোওয়াটের জন্য প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছিল ২১ ডলার। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি মাসে ৩০ লাখ ৪৫ হাজার ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হতো।

এগ্রিকোর ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য এ হারে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়ত তিন কোটি ৬৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। তিন বছরের জন্য কুইক রেন্টাল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। আর এগ্রিকো বিনিয়োগ করেছিল ১০ কোটি ডলার বা ৫৬০ কোটি টাকা। এতে তিন বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করত ১০ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থাৎ মুনাফাসহ তিন বছরে বিনিয়োগ তুলে নিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল।

যদিও হঠাৎ করে মাঝপথে বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। ১৮ মাস বাকি থাকতেই তা আরও ৩৬ মাসের জন্য নবায়ন করা হয়। আর চুক্তি নবায়নের সময় প্রতি মাসে প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ২১ ডলারের ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়িয়ে ৩০ ডলার করা হয়। এতে মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ফলে সাড়ে চার বছরে এগ্রিকো মোট ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে ২১ কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার ডলার। অর্থাৎ বিনিয়োগের দ্বিগুণের বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে নেয় কোম্পানিটি।

এখানেই শেষ নয়; পরে চুক্তির মেয়াদ আরও সাড়ে তিন বছর বাড়ানো হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৮ সালে অবসরে যায়। অর্থাৎ তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলেছে আট বছর। সব মিলিয়ে এ আট বছরে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল মোট ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে দুই হাজার ৫০২ কোটি টাকা। অথচ কোম্পানিটির বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৫৬০ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চারগুণ বা ৪৫০ শতাংশ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদায় করেছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল।

শুধু একটি কেন্দ্র দিয়েই নয়; এভাবেই উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিনিয়োগের কয়েকগুণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এগ্রিকোর আরও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এমনই একটি কেন্দ্র হলো এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৮৫ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১১ সালের ৬ মার্চ উৎপাদন শুরু করা কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে ২০১১ সালের ৩১ মে উৎপাদনে আসে এগ্রিকোর ৯৫ মেগাওয়াট আশুগঞ্জ দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটিও তিন বছরের জন্য লাইসেন্স পায়। তবে কয়েক দফা চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পর মোট আট বছর করে চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি।

দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই প্রতি কিলোওয়াটের জন্য মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয় ৩০ ডলার। ফলে তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হলেও আট বছরে ৮৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় এক হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। তবে তুলনামূলক কম চলায় ৯৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রের জন্য মোট ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই কেন্দ্রে এগ্রিকো মোট ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে দুই হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। যদিও দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এগ্রিকোর বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিনিয়োগের সাড়ে চারগুণ বা ৪৫০ শতাংশ অর্থ এগ্রিকো তুলে নিয়েছে এ দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে।
এদিকে ঘোড়াশালে ম্যাক্স পাওয়ার লিমিটেডের ৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে ২০১১ সালের ২৭ মে। দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক এ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও তিন বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। তবে পরে কয়েক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পর ১০ বছর চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও ধরা হয় প্রতি কিলোওয়াটের জন্য মাসিক ৩০ ডলার। এতে ১০ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ম্যাক্স পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে এক হাজার ৩০৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যদিও এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হয়েছিল মাত্র ৩০০ কোটি টাকা।

একই সময়ে আশুগঞ্জে ৫৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে ইউনাইটেড পাওয়ার, যা ২০১১ সালের ২২ জুন উৎপাদনে আসে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল ইউনাইটেড পাওয়ার। তিন বছরের জন্য রেন্টাল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রেটির লাইসেন্স দেয়া হলেও পরে তা কয়েক দফা বাড়ানো হয়। এতে ২০১৯ সালে এর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর কেন্দ্রটি তিন বছর বন্ধ ছিল। তবে অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় তিন বছর পর আবারও পাঁচ বছরের জন্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার অনুমতি পায় ইউনাইটেড গ্রুপ। ২০২২ সালের শুরুতে অনুমোদন পাওয়ার পর তা আগামী বছর জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।

সূত্রমতে, বন্ধ হওয়ার আগে আট বছরে কেন্দ্রটির জন্য প্রায় ৭৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পায় ইউনাইটেড আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি। মাঝে তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২-২৩ অর্থবছর আরও ৬৩ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পায় কেন্দ্রটি। এতে ৮৫৩ কোটি টাকা বা নির্মাণব্যয়ের প্রায় সাড়ে তিনগুণ ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় হয়ে গেছে। পরের অর্থবছরগুলো মিলিয়ে কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকায় ঠেকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে তৎকালীন পিডিবির চেয়ারম্যান বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে পিডিবির বর্তমান সময়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি। আর ঘাটতির এ সুযোগকে দুর্নীতির জন্য কাজে লাগানো হয়েছে বেশি হারে। এজন্য ওই সময়ে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল বিনা দরপত্রে। তারা আরও জানান, পরবর্তী সময়ে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। ওই কেন্দ্রগুলোয় কিলোওয়াটপ্রতি মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ থেকে ১২ ডলার। অর্থাৎ ঘাটতির সুযোগের আড়াই থেকে তিনগুণ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছিল বিনা দরপত্রের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। এতে প্রচুর অর্থ গচ্চা গেছে। যদিও এসব ক্যাপাসিটি চার্জও ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে বলেই জানা গেছে।

এ বিষয়ে ওই সময়ে বিনা দরপত্রে অনুমোদন পাওয়া দেশীয় একাধিক বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ বা ২০১১ সালে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছিল সেগুলোর পুরো ক্যাপাসিটি চার্জ তারা পায়নি। এর অর্ধেক তারা পেত, বাকি অর্ধেক সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হতো। তবে কাদের কাছে সে অর্থ গেছে, তা ওই কোম্পানির কেউই স্পষ্ট করে জানাতে সম্মত হননি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০