রফিক মজিদ, শেরপুর: শেরপুর জেলায় প্রতি বছর ব্যাপক আলুর আবাদ করা হয়। বিশেষ করে শেরপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলে এই আলুর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। বর্তমানে কৃষকরা তাদের জমি থেকে আলু তোলার কাজ প্রায় শেষ করেছে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে তারা তাদের জমিতে পরবর্তী ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করবে। এই ১৫-২০ দিনের মধ্যে এলাকার দুস্থ নারীরা ওই পরিত্যক্ত আলু ক্ষেত এবং ক্ষেতের আইল বা বাথরের পাশ দিয়ে মাটি খুঁড়ে অবশিষ্ট আলু তুলে আনবে। এতে জমির মালিকরা ওইসব দুস্থ নারীদের জন্য জমি উম্মুক্ত করে রাখে। তবে কোনো কোনো জমির মালিক আলু তুলতে থাকা নারীদের বাধাও দিয়ে থাকে। যে মাটির পরতে পরতে কৃষকের বেঁচে থাকার নানান স্বপ্ন থাকে, সে মাটির পরতে পরতে পড়ে থাকা প্রতিটা আলুই তাদের স্বপ্ন।
শেরপুর সদর উপজেলার চরমুচারিয়া ইউনিয়নের মোকসেদপুর গ্রাম। এই গ্রাম এবং আশপাশের বেশ কিছু গ্রামের প্রায় শতাধিক দুস্থ ও অসহায় নারী রয়েছে। যারা কিনা এই আলু কুড়ানির কাজ করে থাকেন। প্রতিদিন তারা প্রায় দুই থেকে তিন কেজি পর্যন্ত আলু সংগ্রহ করতে পারে। পরবর্তীতে তারা ওই আলু বাড়িতে নিয়ে নিজেদের খাবারের জন্য ব্যবহার করেন।
শুক্রবার দুপুরে ওই ইউনিয়নের মুচারচর নামা পাড়া গ্রামের মৃত ফরহাদের স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব মহুয়া বেওয়া সকাল থেকেই মোকসেদপুর গ্রামের একটি পরিত্যক্ত আলুক্ষেতে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে আলু তুলছিলেন। মহুয়া বেওয়াকে দেখেই বোঝা গেলো রোদে পুড়তে পুড়তে শরীর প্রায় ছাই হয়ে গেছে। কি আর করা পেটের দায়ে কিছু একটা করতে হবে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ৬ মেয়ের মধ্যে পাঁচজনকে বিয়ে দিয়েছে এভাবেই দিনমজুর আর এটা-সেটা কুড়ানির কাজ করে। সর্বশেষ ছোট মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করলেও অভাবের তাড়নায় নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। মার মতো এদিক সেদিক নানা কাজকর্ম করে সংসারে জোগান দিতে হয়। মহুয়া বেওয়া জানায়, তার শিশু, কৈশোর ও যৌবন কীভাবে কেটে গেছে তা মনে করতে পারছে না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও পেটের দায়ে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটতে হয় এখানে সেখানে। তাই তার জীবনের গল্প বলতে কিছু নেই। গল্প একটাই পেটের জন্য নিরন্তর ছুটে চলা।
ওই ইউনিয়নের মুচারচর পুরান পাড়া গ্রামের একই বয়সের মজিদা বেগম। স্বামী ভাসানি দিনমজুরের কাজ করলেও বেশিরভাগ সময় কর্মহীন থাকে। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। তাই তাকেও সংসারের হাল ধরতে বেছে নিতে হয়েছে এই আলু কুড়ানি এবং দিনমজুরের কাজ। মজিদা বেগম জানায়, তিন মাস আলুর মৌসুমে আলু রোপণ থেকে শুরু করে জমির পরিচর্যা ও সর্বশেষ আলো তুলে দিন হাজিরায় আড়াইশ টাকা পেয়ে থাকেন। এরপর আলু তোলার কাজ শেষ হলে ওই পরিত্যক্ত জমিতে জমির মালিককে বলে আলু কুড়ানির কাজ করে থাকেন। অনেক সময় কোনো কোনো জমির মালিক দূর দূর করে ক্ষেত থেকে বের করে দেয়। তখন অন্যত্র চলে যেতে হয়। পেটের খোরাক জোগাতেই হিমশিম খাওয়া এই মজিদা বেগম কবে নতুন কাপড় কিনেছিলেন তা মনে করতে পারছেন না। বছরের পর বছরজুড়ে দুটি কাপড় দিয়ে চালাচ্ছে পরিধানের কাজ। তার শরীরের মতোই পুরোনো আধাছেঁড়া ও ময়লা কাপড়ের দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই তার। পেটের দায় মেটাতেই তার দিনরাত কেটে যায়।
মাঝপাড়া গ্রামের ইন্তাজ আলীর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম নিজের বয়সের কথা বলতে পারে না। তবে এটুকু মনের রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েক বছর আগে ১২-১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। এরপর তাদের ঘরে তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জš§ হয়। বর্তমানে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়া। ৬ ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মাঝেমধ্যে তার খোঁজ-খবর নেয়। বাকিরা কোথায় আছে তাও পরিষ্কার করে বলতে পারে না। মনোয়ারার ধ্যান-জ্ঞান বলতে একটিই, তা হচ্ছে অসুস্থ স্বামীকে ঘরে রেখে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাদ্যের জোগান দেয়া। আলু কুড়ানি যখন না থাকে তখন মাটিকাটা থেকে শুরু করে এ বাড়ি ও বাড়ি নানা কাজকর্ম করে চাল-ডাল, টাকা-পয়সা যা পায় তা নিয়েই বাড়ি ফিরে। কতদিন ধরে আলু কুড়ানি কাজ করছেন এ প্রশ্ন করা হলে বেদনাভরা হাসি দিয়ে বলেন, ছোটবেলা বাহের (বাবা) সঙ্গে আলু তুলতাম এইটুকু মনে আছে। বিয়ার পর কয়েক বছর ভালাই আছিলাম। পোলাপান অওয়ার পর অভাবে পইরা যাই। তহন থাইকাই স্বামীর সঙ্গে দিনমজুরির কাম করিয়া আইতাছি। কয় বছর হয় স্বামী বিছনায় পড়ছে। তাই পেট চালাইতে একাই কাম করতাছি।
স্থানীয় গ্রামবাসী এবং জমির মালিকরা জানায়, আমাদের এই চলাঞ্চলে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ রয়েছে যারা দিনমজুরের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত-খামারে আলুর সময় আলু তোলা আর ধানের সময় ধান কাটার পর জমি থেকে ধান কুড়ানির কাজ করে থাকে। এসব মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। কারণ পুরুষেরা ভারী কাজ করতে পারলেও নারীরা ভারী কাজ করতে পারে না। তাই তারা এসব পেশায় জড়িত হয়।