বেনজির আবরার : কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে খাদি কাপড়। এশিয়ার বাইরে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এর চাহিদা রয়েছে। সেসব দেশে খাদি কাপড়ের তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদ রফতানি করা হয়।
যেখানে খাদির জন্ম
খাদির আদি ঠিকানা কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা। চান্দিনার মাধাইয়া, কলাগাঁও, কুটুম্বপুর, হারং, বানিয়াচং, ভোমরকান্দি, বেলাশ্বর, মধ্যমতলা, বাড়েরা, গোবিন্দপুর, ছয়ঘড়িয়া, হাড়িখোলা গ্রাম খাদির জন্য বিখ্যাত। একই সঙ্গে দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, নবীয়াবাদ, জাফরাবাদ, সাইতলা, বাখরাবাদ, ভানী গ্রামেরও সুনাম রয়েছে। প্রায় শত বছর ধরে এসব গ্রামের মানুষ খাদি কাপড় তৈরি করে আসছেন। এ অঞ্চলের তাঁতিদের হাতে বোনা তাঁতশিল্পের কদর সেই আমলেও ছিল। স্থানীয় ভাষায় ‘যুগী’ বা ‘দেবনাথ’ নামের একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ করে খাদি। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নানা দেশে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তখনকার দিনে রাঙামাটির তুলা দিয়ে তৈরি হতো খাদি কাপড়।
কুমিল্লার উল্লিখিত স্থানে আজও চরকায় সুতা কেটে কাঠের তৈরি লোম মেশিনে খট খট শব্দ ছড়িয়ে তাঁতিরা বুনে চলেছেন খাদি কাপড়।
নামকরণ
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় বিদেশি পণ্য বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ‘মোটা কাপড়, মোটা ভাত’ সেøাগান ওঠে। দেশি পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়। ওই সময় হাতে কাটা সুতা দিয়ে তাঁতে তৈরি খদ্দর কাপড় গান্ধীজিকে দেওয়া হয়।
১৯২৬-২৭ সালে খাদির তৈরি একটি আট হাত লম্বা ধুতির দাম ছিল মাত্র পাঁচ সিকে। দাম কম হলেও গুণগতমানে ছিল অনন্য। সে সময় শুধু কুমিল্লার অভয় আশ্রম প্রায় ৯ লাখ টাকা মূল্যের খাদি কাপড় বিক্রি করে। তখনকার দিনে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় সরবরাহ করতে গলদঘর্ম হয়ে উঠতেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রুত তাঁত চালানোর জন্য পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে মাটিতে গর্ত করা হয়। গর্তের সমার্থক শব্দ খাদ। এ গর্ত বা খাদ থেকে উৎপন্ন কাপড়টিই খাদি। খদ্দর নামেও পরিচিত এটি। অনেকের মতে খদ্দর থেকে এসেছে খাদি। সতের শতকের দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এ কাপড়ের বুনন বেশ প্রচলিত ছিল।
বিস্তৃতি
১৯৩০ সালে ভারতের অভয় আশ্রম পরিচালিত কুমিল্লার বরকামতায় (বর্তমান চান্দিনা) হাতে কাটা চরকায় সুতা তৈরির কাজ চলতো। সেই সময় সেখানে ডায়িং মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা শৈলেন্দ্রনাথ গুহ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর খাদি শিল্পের ওপর থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হয়, বিপর্যয় নেমে আসে কুমিল্লার খাদি শিল্পে। ১৯৫২ সালে ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় ও তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লায় ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শৈলেন্দ্রনাথ গুহর ধারণা ছিল, খাদি কাপড়ের ব্যবসা প্রসার লাভ করবে। সে স্বপ্ন নিয়েই বরকামতার খাদি কারখানাটি ধরে রাখেন। এভাবে কয়েক যুগ অতিক্রম হয়।
আগেই জেনেছেন, যুগী সম্প্রদায় খাদি কাপড় তৈরি করতেন। তাদের তৈরি ওই কাপড়কে অনেকে খাটো করে দেখতেন। তারা ‘যুইগ্যা’ কাপড় হিসেবে বিবেচনা করতেন। তবে শৈলেন্দ্রনাথও দমে যাওয়ার পাত্র নন। যার সঙ্গে আলাপ করতেন, তাকেই খাদি কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধানের ব্যাপারে অনুরোধ জানাতেন। বলতেন ‘আপনারা বছরে অন্তত একটি খাদি পাঞ্জাবি, পায়জামা বা ধুতি পরুন।’ তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সব নাগরিকের দেহে দেশি পণ্য পরানোর স্বপ্ন দেখতেন।
স্বাধীনতার পর খাদি কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। সাদামাটা রঙের খাদি কাপড় এখন নানা রঙে ছাপা হচ্ছে।
বর্তমান সময়ের খাদি
কুমিল্লা শহরের কয়েকটি পরিবারের পরিশ্রম ও আন্তরিকতার ফলে খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে তরুণী মোহন রায়ের খাদিঘর, শংকর ভট্টাচার্যের খাদি কুটির শিল্প, মনমোহন দত্তের বিশুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডার, কৃষ্ণ সাহার রাম নারায়ণ খাদি স্টোর, দীনেশ দাসের খাদি ভবন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান কুমিল্লা শহরে শতাধিক খদ্দরের দোকান রয়েছে।
খাদি মানেই মোটা কিংবা অমসৃণ কাপড় নয় এখন। এ ধারণা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। মসৃণ, পাতলা, ভারি, নরম, আবহাওয়া উপযোগী প্রভৃতি ধরনের খাদি কাপড় তৈরি করেন এখনকার তাঁতিরা।
শিক্ষার্থী