নিজস্ব প্রতিবেদক: ক্যাসিনো চালানোর তথ্য প্রকাশের পর আত্মগোপনে থাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি এনামুল হক আরমানকে অবশেষে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতারের পর ঢাকায় এনে সম্রাটের কাকরাইলের অফিস ও শান্তিনগরে তার ভাইয়ের বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, শনিবার গভীর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাট ও আরমানকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে আলোচনায় ছিল যুবলীগ নেতা সম্রাটের নাম। সেদিন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া গ্রেফতার হওয়ার পর সদলবলে কাকরাইলে নিজের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে রাতভর সেখানে ছিলেন সম্রাট। কিন্তু এরপর তিনি নিরুদ্দেশ হন।
র্যাবের অভিযানের সময় মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের ভেতরে সম্রাটের বিশাল ছবি দেখা যায়। ওই ক্লাবের ক্যাসিনো তিনিই চালাতেন এবং মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় অন্য ক্যাসিনোগুলো থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তার কাছে যেত বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।
সম্রাটের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা আরমানও দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনোর কারবারে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঢাকাই সিনেমাতেও টাকা খাটাচ্ছিলেন।
আরমানের প্রোডাকশন হাউস ‘দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া’র ব্যানারে প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পায় গত কোরবানির ঈদে। ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ নামের ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও বুবলী।
চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক হেলাল আমাদের কুমিল্লা প্রতিনিধিকে জানান, কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের যে বাড়ি থেকে সম্রাট ও আরমানকে ধরা হয়েছে, সেটি স্টার লাইন পরিবহনের মালিক আলাউদ্দীনের ভগ্নিপতি মনিরের বাড়ি। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল র্যাব। তবে মনির কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল।
সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের চাঁদাবাজি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষ প্রকাশ পাওয়ার পর জুয়ার আখড়া বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অভিযান শুরু হয়।
মতিঝিলের ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর ঘটনায় ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। পরদিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেফতার হন কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। দুদিন পর নিকেতন থেকে গ্রেফতার করা হয় ঠিকাদার জি এম শামীমকে, তিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।
‘অপকর্মকারীদের’ বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অত্যন্ত কঠোরÑএমন বার্তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে আসার পর আত্মগোপনে যান সম্রাটসহ যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা।
তাদের মধ্যে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল এবং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদের নামও এসেছে।
সম্রাট নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকম খবর আসছিল সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু যুবলীগের অফিস কিংবা বাসা কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়; তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের এই নেতাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে বলে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে শোনা গেছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলে আসছিলেন, ‘সম্রাট হোক আর যেই হোক,’ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে সম্রাটকে কুমিল্লায় গ্রেফতার করার পর তার অফিস ও দুই বাসায় একযোগে অভিযান চালাচ্ছে র?্যাব। র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে তার অফিসে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চলছে।
এছাড়া শান্তিনগরে শেলটেক টাওয়ারের পঞ্চম তলায় এবং মহখালী ডিওএইচএসের ২৯ নম্বর সড়কে সম্রাটের দুটি বাসায় অভিযান চলছে বলে র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রোববার বেলা দেড়টায় একটি হেলমেট-পরিহিত সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে তালা ভেঙে কাকরাইলের ভূইয়া টাওয়ারে ঢুকতে দেখা যায় র্যাব সদস্যদের। এ সময় র্যাব সদস্যরা ওই ভবনের সামনে অবস্থান নেন, ভবনের প্রধান ফটকের কল্যাপসিবল গেট আটকে দেওয়া হয়।
সম্রাটের অফিসে এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। র্যাবের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে আছেন। ভূঁইয়া ম্যানশনের নিচতলার সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে ভিড় করেছে উৎসুক জনতা।
ওই ভবনের সামনে দুই পিলারের একটিতে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, অন্যটিতে সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের ছবি রয়েছে। হারুনের ছবির নিচেই রয়েছে ইসমাইল হোসেন সম্রাটের হাস্যোজ্জ্বল ছবি।
স্থানীয়রা জানান, এই ভবনেই সম্রাট দিনের বড় একটি সময় কাটাতেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিয়ান শুরুর পরও দিন কয়েক তিনি ভূঁইয়া ম্যানশনের অফিসে ছিলেন। শতাধিক যুবক তখন ওই ভবন পাহারা দিয়ে রেখেছিল।
এদিকে গতকালের অভিযানে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, এক হাজারের বেশি ইয়াবা, একটি পিস্তল ও দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র্যাব। এছাড়া সেখানে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে জানিয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, সেগুলো নির্যাতন করার কাজে ব্যবহার করা হতো বলে তাদের ধারণা।
ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও এনামুল হক আরমানকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর মধ্যে সম্রাটের সাজা হয়েছে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে, তার কাকরাইলের অফিসে দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে। আর কুমিল্লায় গ্রেফতারের সময় আরমান ‘মদ্যপ’ থাকায় তাকে সেখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে র?্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানিয়েছেন।
বাসা ও অফিসে র্যাবের অভিযান
কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার যুবলীগ নেতা সম্রাট ও আরমান
