আমরা জানি, অন্যের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এ বোধ সঞ্চারিত হয় জীবনের সব ক্ষেত্রে পপ সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র থেকে ধর্ম, কিংবা আধ্যাত্মিকচর্চায়। আমরা যখন কৃতজ্ঞতাবোধ করি, তখন এক ধরনের ভালোলাগা তৈরি হয় আমাদের মধ্যে। তবে ধারাবাহিকভাবে এ চর্চা চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। কৃতজ্ঞতাবোধ ধরে রাখাও বেশ দুরূহ।
গবেষকদের মতে, নেতিবাচক ভাবাবেগের কারণে ধারাবাহিকভাবে কৃতজ্ঞ থাকার চর্চা করা সম্ভব হয় না। কারণ, ইতিবাচক ভাবনার তুলনায় নেতিবাচক ভাবনা বেশ শক্তিশালী এবং তা দীর্ঘদিন মনে লেগে থাকে।
ড. বারবারা ফ্রেড্রিকসন তার পজিটিভিটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, দুঃখবোধ কিংবা রেগে যাওয়া ইতিবাচক আবেগের চেয়ে শক্তিশালী। আদতে একটি নেতিবাচক আবেগের বিরুদ্ধে যুঝতে কৃতজ্ঞতার মতো তিনটি ইতিবাচক আবেগ দরকার। তবু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত কৃতজ্ঞতার অনুশীলন জরুরি। উপরন্তু মানসিক সক্ষমতাসহ সার্বিক জীবনাচরণে সহায়ক এ কৃতজ্ঞতাবোধ।
গত ২০ বছরে কৃতজ্ঞতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। গবেষকরা একজন মানুষের জীবনকালে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক নানা বিষয়ের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্পর্কের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। গবেষণায় প্রমাণিত যে, সামাজিক মেলামেশা উন্নত করে কৃতজ্ঞতাবোধ। ভালো ঘুম, সম্পর্কে সন্তুষ্টি ও মানসিক ধকল কাটাতে সহায়তা করে এটি। শুধু মানসিক সুস্বাস্থ্যই নয়, শারীরিক সুস্বাস্থ্যেও এটি অপরিহার্য।
স্তন ক্যানসার থেকে আরোগ্য লাভ করা ৬৭ নারীর ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়। তাদের কৃতজ্ঞতার ওপর ছয় সপ্তাহের একটি অনলাইন কোর্স করতে বলা হয়। দেখা যায়, এতে তাদের ক্যানসারভীতি দূর হয়ে গেছে। ৯৬ পুরুষ কয়েদির ওপর পাঁচ সপ্তাহের অনুরূপ একটি কোর্স পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অতীতের আগ্রাসী মনোভাব আর নেই।
সুতরাং, কৃতজ্ঞতার অনুশীলন যে বিজ্ঞানসম্মত এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে নিজেদের মধ্যে এ বোধ সৃষ্টির উপায় কী? এজন্য কয়েকটি বিষয়ে অনুশীলন করতে পারেন:
শোবার আগে ভাবুন
গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদিনে ঘটে যাওয়া ভালো ঘটনাগুলো যারা মনে প্রতিফলিত করেন, তারা নেতিবাচক ভাবনা নিয়ে বিছানায় যাওয়া মানুষের তুলনায় ভালো ঘুমান। তাই যেভাবেই হোক, নিজের চিন্তাকে ইতিবাচক করে তুলুন। আজ সারাদিনে যেসব সুন্দর ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন। যে অপরিচিত ব্যক্তি দরজা খুলে দিয়েছিলেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। যিনি সরে আপনার হাঁটার পথ মসৃণ করেছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন। ক্ষুদ্র, অথচ ইতিবাচকÑএমন বিষয় নিয়ে ভাবুন। দেখতে পাবেন, কৃতজ্ঞ থাকার হাজারো বিষয় মনে ভর করেছে। এতে সুখবোধ করছেন।
আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানাতে পারেননি যাকে, তাকে ই-মেইল করুন
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী ও আত্মউন্নয়ন বইয়ের লেখক সেলিগম্যান ও তার সহকর্মীরা একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখতে পান, যেসব ব্যক্তি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ অন্যকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ না জানানোর কারণে চিঠি লিখেছেন, তারা সুখবোধ করেন। তাদের বিষন্নতার মাত্রা কমে গেছে। অনুরূপ আপনিও অনুশীলন করতে পারেন। আপনার জীবনে যাদের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যারা আপনাকে বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছেন; কিন্তু আপনি তাদের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেননি, এমনকি ধন্যবাদও জানাতে পারেননি তাদেরকে নিয়ে ভাবুন। চিন্তার কিছু নেই। আজই তাদের ই-মেইল করুন। মেসেজ দিতে পারেন। দেখবেন মানসিক শান্তি ও স্বস্তি পাচ্ছেন।
কৃতজ্ঞতার নোট বা খাতা সঙ্গে রাখুন
আপনি যাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, তাদের পাঁচজন অথবা পাঁচটি বিষয়ের তালিকা করে একটি নোট বা খাতায় তাদের নাম কিংবা বিষয়গুলো লিখে রাখুন। দিনশেষে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আজ এ মানুষগুলোর কাছ থেকে কীভাবে উপকৃত হয়েছেন। প্রশ্ন করুন, কি দেখেছি, যে কারণে কৃতজ্ঞতাবোধ করছি। এ ভাবনা থেকেই কৃতজ্ঞতাবোধ সঞ্চার হবে আপনার ভেতরে। এ চর্চার জন্য স্মার্টফোনের সহায়তা নিতে পারেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিয়ে কোথায় থামতে হবে, কখন চিন্তা করতে হবে, তা নির্ধারণ করে নিন।
গবেষকরা কৃতজ্ঞ থাকার শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, আরও অনেক উদাহরণ তারা আমাদের সামনে হাজির করতে পারবেন। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, কোনো মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য ধারাবাহিকভাবে কৃতজ্ঞ থাকার অনুশীলন অপরিহার্য। এতে উন্নত হয় জীবনমান।
সাইকোলজি টুডে অবলম্বনে রতন কুমার দাস