মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প

কৃত্রিম চ্যানেলে পাওয়া যাবে গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা

মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: একদিকে নীল পানি আর উভয় পাশে ঘোলা পানি। নীল পানির ধারাটি হলো পলিবিহীন, যাকে বলা হচ্ছে ‘কৃত্রিম চ্যানেল।’ যেখান দিয়ে চলাচল করবে জাহাজ। কৃত্রিম চ্যানেল তৈরিতে সাগরের অংশে পাথরের ব্লক ফেলে পলি আসা ঠেকানো হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘ব্রেক ওয়াটার।’ মহেশখালীর মাতারবাড়ীর ধলঘাটে সাগরে মাটি কেটে তৈরি করা ২৫০ মিটার চওড়া কৃত্রিম চ্যানেলটিকে বাড়ানো হবে ৩০০ মিটারে। ১৪ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ চ্যানেলের গভীরতা ১৮ মিটার, যেখানে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। তবে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারলেই বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দরের যাত্রা শুরু হবে। অর্থাৎ, কৃত্রিম চ্যানেলেই পাওয়া যাবে গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা। এখানেই ভিড়বে সবচেয়ে দীর্ঘ জাহাজগুলো। তাই বলা হচ্ছে, ২০২৫ সালে মাতারবাড়ী বন্দর হবে বাংলাদেশের প্রথম খননকৃত গভীর সমুদ্রবন্দর। অনেকে একে বলছেন, ‘মাতারবাড়ী ডিপ ড্রাফট টার্মিনাল’।

চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানা দক্ষিণে মাতারবাড়ী ডাউন আর উত্তরে মিরসরাই এবং উপকূল থেকে ৯ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ভেতরে যত স্থাপনা হবে এবং জাহাজ আসবে, তা চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩৮ নটিক্যাল মাইল দূরে মাতারবাড়ী। আর এখানেই জাইকার অর্থায়নে সরকারি খাতের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির জন্য কয়লা মজুতের গুদাম এবং জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের জন্য একটি জেটি নির্মাণের পাশাপাশি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় জাইকা। এ চ্যানেল তৈরির কার্যক্রম শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (চবক) জানায় সংস্থাটি। 

জাইকার মতে, বাংলাদেশে ডিপ ড্রাফটের জাহাজ আসার একমাত্র জায়গা হচ্ছে মাতারবাড়ী আর সেভাবেই ডিপ টার্মিনাল নির্মাণের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে জাইকা। এভাবেই শুরু হয় মাতারবাড়ীতে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প। এ লক্ষ্যে ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সমীক্ষা পরিচালনা করে জাইকা। তার ভিত্তিতে চবক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর যৌথভাবে একটি ডিপিপি তৈরি করে। ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর। এতে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা (০.০১ ও ০.৯৫ শতাংশে সুদে), দুই হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের এবং চবকের নিজস্ব অর্থ দুই হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের জন্য এক হাজার ২২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে।

এরই মধ্যে ১৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে এবং ৬৮ একর অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের অধীনে একটি ৩০০ মিটারের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং ৪৬০ মিটারের একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। আর ২৭ দশমিক সাত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করবে সড়ক ও  জনপথ অধিদপ্তর।

প্রকল্প বিষয়ে জাইকার বাংলাদেশস্থ প্রধান প্রতিনিধি হিতোশি হিরাতা গত ২১ জানুয়ারি সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী জানান, ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টটি’ শিগগির একনেক সভায় পেশ করা হবে।

চবকের মেরিন বিভাগ জানায়, ইতোমধ্যে মাতারবাড়ীতে কৃত্রিম চ্যানেল ও বেসিন (লেক বা পুকুর), উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ব্রেক ওয়াটার, ৭০ মিটারের একটি সার্ভিস জেটি করেছে জাইকা এবং ২৩০ মিটারের আরও একটি জেটি করবে তারা। আর প্রথম ফেইজে দুটি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঁচটি জেটি করবে চবক। টার্মিনাল হলে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অফিস, ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, জলযান বা ট্যাগ, পাইলট ভেসেল, সিকিউরিটি বোট, জনবল প্রভৃতির প্রয়োজন হবে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে যতদিন পর্যন্ত ২৭ দশমিক সাত কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ হবে না, ততদিন পর্যন্ত মাতারবাড়ী টার্মিনাল অপারেশনে যেতে পারবে না। জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলে কাজ শুরু করবে চবক।

মাতারবাড়ীতে আলাদা বন্দর হওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে চবকের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর এম শফিউল বারি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে মাতারবাড়ীতে একটি টার্মিনাল হবে। এখানে ডিপ ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারবে। এটি গভীর সমুদ্রে হচ্ছে না। মাতারবাড়ীতে সমুদ্রে চ্যানেল কেটে গভীর করা হয়েছে। ১৪ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার লম্বা এ চ্যানেলকে ড্রেজিং করে ১৮ মিটার গভীর করা হয়েছে। তার মানে, এখানে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে দুই হাজার টিইইউজ কনটেইনারের ৯ দশমিক পাঁচ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। মাতারবাড়ীত ভিড়বে আট হাজার টিইইউজ কনটেইনারের জাহাজ।’

গত ২৯ জানুয়ারি নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি দল মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে। এ সময় চবক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে প্রচুর উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৪৩ সালে ১৪ মিলিয়ন টিইইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার প্রয়োজন হবে। যেখানে বর্তমানে আমরা মাত্র তিন মিলিয়ন টিইইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করছি। বিশাল পরিমাণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার জন্য আরও নতুন নতুন টার্মিনালের প্রয়োজন। তারই ধারাবাহিকতায় মাতারবাড়ীতে নতুন টার্মিনাল হচ্ছে। এটি আমাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে আরও সহায়তা করবে।’

তিনি জানান, ২০২৪ সাল নাগাদ এটি চালু হবে। ড্রেজিংসহ পরবর্তী কাজ চট্টগ্রাম বন্দরই করবে। এটি করলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে এবং চট্টগ্রামে টোটাল বাণিজ্যে অগ্রগতি হবে। দুটি জেটি দিয়ে শুরু হবে। পরে যখন বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আরও উন্নত হবে, অনেক কার্গো আসবে, তখন এটি পুরোদমে চালু হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০