Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 6:45 pm

কৃষকের ক্ষতি করেও ‘কৃষিপণ্য’ তামাক

পলাশ শরীফ: কেবল ধূমপানই নয়, এটির প্রধান কাঁচামাল তামাক চাষও ক্ষতি করে কৃষকের। এটির চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ কৃষকের নানা স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ। পাশাপাশি তামাক চাষ জমির উর্বরা শক্তিও নষ্ট করে। কৃষি ও কৃষকের জন্য এসব ক্ষতিকর উপাদান বহন করা সত্ত্বেও কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃত তামাক। আর এটি ‘কৃষিপণ্য’ হওয়ার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা নিচ্ছে তামাক উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো।

সিগারেটের প্রধান কাঁচামাল তামাক। কয়েক দশক আগে এটিকে কৃষিপণ্যের তালিকায় রাখে কৃষি অধিদফতর। পরবর্তী সময়ে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় তামাক চাষ ও উৎপাদিত পণ্যের বিপক্ষে অবস্থান নেয় সরকার। তামাক চাষ ও উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার বন্ধে কাজ করছে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো। কিন্তু এখনও কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে তামাকে সরানো হয়নি। তামাক এখনও ওই তালিকায় রয়েছে। কৃষিপণ্যের তালিকায় রেখেই তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার পদেক্ষপ নেওয়া হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, কৃষিপণ্যের তালিকায় থাকার কারণে কৃষকদের তামাক চাষ থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। কিছু কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তামাক চাষ বেড়েই চলেছে। তামাক চাষ বন্ধে সরকারিভাবে প্রচার চালানো হলেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে জমির উর্বরা শক্তি কমছে। বাড়ছে পরিবেশ বিপর্যয়ও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। সরকারও তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু এটিকে কৃষিপণ্যের তালিকায় রেখে এর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সাংঘর্ষিক।’

তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থেই তামাক চাষ বন্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সময় এসেছে। তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সেজন্য সবার আগে এটিকে কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কারণ এটি কৃষিপণ্য হিসেবে থাকলে কৃষকরা চাষ করবে। কোম্পানিগুলো কৃষিপণ্যের ওপর উৎসে কর অব্যাহতির সুযোগ নিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাবে। অন্যদিকে তামাকপণ্যকে নিরুৎসাহিত করতে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের ওপর যত ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করা যায়, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে।’

অন্যদিকে কোনো ধরনের মূসক উৎসে কর ছাড়াই বিড়ি-সিগারেটের কাঁচামাল হিসেবে তামাক ব্যবহার করছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে অস্পষ্টতা ও ভ্যাট আইনে কৃষিপণ্যের ওপর উৎসে কর অব্যাহতির কারণে উৎসে কর আরোপ করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর জের ধরে সিগারেটের কাঁচামালের ওপর উৎসে কর দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো। ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দুটি সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছ থেকে উৎসে কর আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল এনবিআর। কিন্তু আইনি জটিলতায় রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া আটকে আছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তামাককে কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে সরানোর জন্য তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। তামাক ইস্যুতে সরকারের অবস্থানকে স্ববিরোধী বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তামাকবিরোধী জোটের মুখপাত্র আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘যখন তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ধারণা ছিল না এবং বিশ্বজুড়ে তামাকের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠেনি, সেই সময়ে আমাদের দেশে তামাককে কৃষিপণ্য ঘোষণা করা হয়। কয়েক বছর ধরে ওই পণ্যকে কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এখনও সেটি সেই তালিকায় রয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। তাই কৃষিজমি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাককে কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে সরাতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষিজমিতে তামাক চাষ বন্ধে বিশেষ কর ও পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ করও আরোপ করা যেতে পারে।’

বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো ১৯৬৪ সালে প্রথম রংপুরে পরীক্ষামূলকভাবে তামাক চাষ শুরু করে। স্বাধীনতার পর তারা ব্যাপকভাবে চাষ শুরু করে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় তামাক চাষ সম্প্রসারণ করতে থাকে। মাত্র দু-তিনটি তামাক পাতার জাত (যেমন মতিহারী, বার্লি ও ভার্জিনিয়া যাকে ‘ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া’ বলা হয় তার চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় এক লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আগে ‘ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া’ আমদানি করে সিগারেট বানাতো। এখন বাংলাদেশেই ‘ফ্লু কিউর্ড ভার্জিনিয়া’ পাতা উৎপাদন করছে। এখন আমদানির বদলে বাংলাদেশ থেকে তামাক পাতা বিদেশে রফতানি হচ্ছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই, বিশেষ করে ধনী দেশে, এখন তামাক চাষ নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে তামাক রফতানি করে আয় হয়েছে পাঁচ কোটি ডলার। এর বিপরীতে একই অর্থবছরে ৯ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য ও চার কোটি ডলারের সবজি রফতানি হচ্ছে। সেই হিসেবে তামকের বদলে জমিতে কৃষিপণ্য আবাদ করলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হতো বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।