Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:55 am

কৃষিঋণ বিতরণে পিছিয়ে ৩৮ ব্যাংক

রিজাউল করিম: দেশের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি। তাই কৃষি ও কৃষককে চাঙা করতে ব্যাংকগুলোর জন্য লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে কৃষিঋণ বিতরণে। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস (জুলাই-জানুয়ারি) পেরিয়ে গেলেও সে লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। দেশের সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলে ৫৫ ব্যাংকের মধ্যে ৩৮ ব্যাংকই কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে কম ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির জন্য ১৯০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বিতরণ করেছে মাত্র তিন কোটি ৬৪ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রায় পিছিয়ে থাকা দ্বিতীয় ব্যাংকটি হচ্ছে মধুমতি ব্যাংক লিমিডেট। ব্যাংকটির জন্য পুরো অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারিত থাকলেও বিতরণ হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা। কৃষিঋণ বিতরণে পিছিয়ে থাকা ব্যাংকের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ১০৫ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ঋণ দিয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কৃষিঋণ বিতরণে খোদ বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অর্জন করেছে ৬৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ব্যাংকটির জন্য পুরো অর্থবছরে চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছরের গত সাত মাসে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে মাত্র তিন হাজার ১১৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক মাত্র ৩৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৪৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। তবে আলোচ্য সময়ে জনতা ব্যাংক ৭২ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে।

এছাড়া বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এর জন্য তিন কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্থবছরের সাত মাসে একটি টাকাও বিতরণ করেনি ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর জন্য ২০১৬-১৭ পুরো অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য থাকলেও এ পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ১২ হাজার ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) কৃষি খাতে লক্ষ্যমাত্রার ৬৯ দশমিক ২৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। তবে অর্থবছরের সাত মাসে দেশের সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলে ১৭টি ব্যাংক এরই মধ্যে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সবচেয়ে বেশি ৭৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বিদেশি হাবিব ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির জন্য পুরো অর্থবছরে আট কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য থাকলেও বিতরণ হয়েছে ৬০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে রবি ফসল উৎপাদনে।

আমন চাষাবাদের সময় কৃষকদের বেশি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। যে কারণে বর্তমানে সারসহ কৃষি সরঞ্জামাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা ঋণ ছাড়া চলতে পারছেন না। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণে ক্রমেই বাড়ছে কৃষকের আগ্রহ। কিন্তু ফসল উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম কম পাওয়ায় মুনাফা করতে পারছেন না কৃষকরা। ফলে ঋণ করে ফসল ফলিয়েও আগের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন কৃষকরা। আর কৃষকের ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় ব্যাংকগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঋণ দিয়ে খেলাপি বাড়ানোর চেয়ে না দেওয়ায় ভালো মনে করছে ব্যাংকগুলো, যার প্রভাবে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণে পিছিয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যতই বলুক তফসিলি ব্যাংকগুলো আগের গতানুগতিক মানসিকতায় রয়ে গেছে। তাই কৃষিঋণ বিতরণে তারা আগ্রহ দেখায় না। কৃষি ও কৃষকদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর মাথাব্যথা নেই। তাদের মাথাব্যথা বড় ঋণ নিয়ে। অর্থশালী গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে সক্ষমতা গড়ে তুলতেই ব্যাংকগুলো ব্যস্ত। তাই কৃষিঋণের লক্ষ্যপূরণে ব্যাংকগুলোর পিছিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পুরোনো মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও পরামর্শ ও কঠোর নির্দেশনা থাকতে হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর এমন গড়িমসির কারণে তফসিলি ব্যাংক নির্বাহী ও কৃষি বিভাগের প্রধানদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের মান ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিশেষ তাগাদা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাগাদায় ফসল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ, মৎস্য চাষ এবং পশুপালনে ঋণ নিশ্চিত করতে বলা হয়। বৈঠকে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ‘কৃষিঋণ সেল’ গঠনে তাগাদা দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। ওই বৈঠকে কৃষিঋণ বিতরণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিতরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। চলতি বছরের সাত মাসেও ব্যাংকটি কোনো কৃষিঋণ বিতরণ করেনি।

চলতি অর্থবছর থেকে কৃষি ও পল্লিঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ১১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আমানত ও ঋণের সুদহার কমে আসার প্রবণতা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা পুনর্নির্ধারণ করে। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর এক পরিপত্র জারি করে ১১ শতাংশ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ছিল ১৩ শতাংশ। এছাড়া মসলাজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ অব্যাহত রয়েছে।