কৃষিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের শঙ্কা

মেহেদী হাসান, রাজশাহী : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্যের বাজারদর আগে থেকেই টালমাটাল। কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় ও লজিস্টিকস সংকটের ফলে তা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে ক্রমাগত। এবার প্রান্তিক কৃষকের জীবনকে আরও কঠিন করে দিয়ে ডিজেল ও সারের দাম এক লাফে বাড়ানো হলো অনেকখানি। এক রাতের মধ্যে ডিজেলে দাম ৪২.৫% বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা হয়েছে, যা আগে ছিল ৮০ টাকা। কৃষি বিষেষজ্ঞরা বলছেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে ডিজেল, ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধি।

আন্তর্জাতিক বাজারে ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম। এর প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে সার উৎপাদন।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সারের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানিটির দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চে উঠবে। ফলে সারের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে সার ও ডিজেলের দামে প্রভাব কতটুকু জানতে কথা হয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে এ বিষয়ে একাধিকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছি। বৈশ্বিক

পরিস্থিতিতে সারের কারণে নতুন করে যাতে আর সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের অন্যান্য খাতের ভর্তুকি কমিয়ে সারে ভর্তুকি বাড়াতে হবে, যাতে সারের দাম কম থাকে।

সার ও ডিজেলের দাম বৃৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর তানোরের স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে সারের সংকট নেই। আসলে এখনই তো সারের সংকট চলছে। হঠাৎ করে ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ৬ টাকা ছিল কেজিতে ১৬ টাকা বৃদ্ধি করা হলো। ডিলাররা বলেন, ইউরিয়া সার নেই আবার হঠাৎ সারের বস্তা হাজির হয়। যাদের টাকা বেশি আছে তারাই সার পায়। পাঁচ দিন আগে আমি ১৬ টাকা কেজির ইউরিয়া সার কিনেছি এখন ১৮ টাকায়। ডিলার পর্যায় থেকে কৃষক পর্যায়ে আরও সংকট হবে।

প্রভাব কতটুকু পড়বে জানতে চাইলে এই কৃষক বলেন, ডিজেল দিয়ে শ্যালো মেশিন চালানো হয়। সেচ দিতে শ্যালো মেশিন ব্যবহার হয়। ফসল উঠান সঙ্গে সঙ্গে ধানের দাম কমে যায়। ধানের ন্যায্য দাম পান না কৃষকরা। এ জন্য ধান ছেড়ে তারা অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক কৃষক ধান ছেড়ে আমবাগান করছেন। বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে কৃষকেরা ৩০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন। আর আমন মৌসুমে ২৫ কেজি। চাষি এক বিঘা আলু চাষে ২৭ থেকে ১০০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর কারণে ফসলের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। বেশি খরচ করে উৎপাদন করা ফসল ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারলে কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দেবে। এতে তারা ধান ছেড়ে অন্য ফসলের দিকে আগ্রহী হবেন। আলু চাষের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। এতে খাদ্যসংকটের সৃষ্টি হতে পারে।

সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা। এর ফলে ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ডিএপি সারে শতকরা ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সেজন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ডিএপি ব্যবহার হতো ৮ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ লাখ টন। ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ার ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ইউরিয়ার ব্যবহার বেড়েছে। ২০১৯ সালে ইউরিয়া ব্যবহার হতো ২৫ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে তিন ধরনের পণ্যের আমদানি হয়, মোট আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। এগুলো জ্বালানি, খাদ্য এবং সার। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তিন ধরনের পণ্যের দামই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে সারে সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।

রাজশাহীতে সারের সংকট আছে কি না জানতে কথা হয় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি মো. আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজশাহীতে ডিএপি ও টিএসপি সারের সংকট রয়েছে। কয়েকদিন আগে রাজশাহীতে কৃষিমন্ত্রী এসেছিলেন। আমি সরাসরি মন্ত্রী মহোদয়কে বলেছিলাম, রাজশাহীতে সারের সংকট রয়েছে। কিন্তু তার সদুত্তর পাইনি। সারের কতখানি মজুত রয়েছে তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলতে পারবে। আমাদের হিসাবে সারের সংকট রয়েছে।

ডিজেল ও সারের দামে বাড়ার কারণে কী কী প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে আমি এখন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না। এটার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। এ বছর ফসলে খরচ বেড়ে গেলে কৃষকরা আগামী বছর তা কমিয়ে দেবে। সমস্যা আরও জটিল হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্রের রাজশাহী অঞ্চলের অফিস প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফজলুল ইসলাম বলেন, সার ও সেচ ধান ফসলের প্রাণ। হঠাৎ করে সারের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পরিমিত পরিমাণ সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করার টেকনিক কৃষকরা এখন শিখে গেছে। কিন্তু দাম বাড়লে তাদের কিছু করার থাকে না। ইউরিয়ার মূল উপাদান নাইট্রোজেন। বেশি দিয়ে লাভ হয় না। তাই সরকার অনুমোদিত মাত্রায় দিতে হবে। ব্রি থেকে সবসময় পরামর্শ দেয়া হয়।

অতিরিক্ত সার ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তানোরের পাঁচন্দর এলাকার কৃষক রাকিব উদ্দিন বলেন, কৃষকেরা মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সার ব্যবহারের যে মাত্রা

বেধে দেয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী ইউরিয়া ব্যবহার করলে উৎপাদন কম হয়। কারণ, মাটির উর্বরতা শক্তি অনেক কমে গেছে। এ জন্য কৃষকেরা ইউরিয়া বেশি দিয়ে ফলন বেশি করার চেষ্টা করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০