জমি ও ফসলের উপযোগী সার গুটি ইউরিয়া। আজ এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো
বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধান। তবে কৃষিব্যবস্থা উন্নত হলেও ধানের উৎপাদন তেমন বৃদ্ধি পায়নি। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক সার অথবা ভুল পদ্ধতিতে সার প্রয়োগের ফলে চাহিদামতো ধান উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন কৃষক। অনেক সময় নিম্নমানের ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। ফলে ধানগাছ সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না।
কৃষকের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ ফলন বৃদ্ধির জন্য ‘গুটি’ ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সার ব্রিকেট মেশিনের সাহায্যে সহজে তৈরি করা যায়। এটি যেমন ফসল বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, তেমনি অপচয় রোধ করতেও সাহায্য করে।
গুটি ইউরিয়া নাইট্রোজেন সমন্বিত একটি রাসায়নিক সার। এটি দেখতে অনেকটা ন্যাপথালিন ট্যাবলেটের মতো। ব্রিকেট মেশিনের সাহায্যে দানাদার ইউরিয়া সার বড় আকারের গুটি ইউরিয়ায় পরিণত করা হয়।
বর্তমানে বাজারে তিন সাইজের গুটি ইউরিয়া পাওয়া যায়। এগুলো হলো ছোট সাইজ (০.৯০ গ্রাম), মধ্যম সাইজ (১.৮ গ্রাম) ও বড় সাইজ (২.৭০ গ্রাম)।
কৃষক সাধারণত জমিতে ছিটিয়ে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেন। এ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা সারের শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ গাছ গ্রহণ করতে পারে আর বাদবাকি ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ গাছের কাজে আসে না। কারণ ইউরিয়া সার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোলাটিলাইজেশন পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস, নাইট্রিফিকেশন, ডিনাইট্রিফিকেশন, নাইট্রোজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস হিসেবে উড়ে যায়। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে আগাছা বিস্তার ও বংশবিস্তারে সহায়ক। একই সঙ্গে পরিবেশও দূষণ করে।
গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহারে নাইট্রোজেন সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ইউরিয়া সার কম লাগে। গুটি ইউরিয়া জমিতে প্রয়োগের পর সব সময় গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোনো সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না। এই সার মাটিতে বিদ্যমান অন্যান্য খাদ্য গ্রহণে গাছকে সাহায্য করে এবং প্রয়োগকৃত ধানের খড়ে পুষ্টিমান বেশি থাকে বলে গরুর খাদ্য হিসেবে উন্নতমানের হয়।
গুটি ইউরিয়ার অবদান
গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহারে অপচয় অনেকাংশে রোধ হয় এবং সারও কম লাগে। এটি জমিতে একবার প্রয়োগই যথেষ্ট। ফলে বারবার প্রয়োগের ঝামেলা থাকে না এবং খরচও কম হয়। খরার সময় গুটি প্রয়োগকৃত জমি তুলনামূলক ভালো থাকে। কারণ গুটির প্রয়োগ করা ধানগাছের শিকড় লম্বা হয় এবং মাটির গভীরে যায়। কাজেই ধানের ফলনও ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে বেশি ফলন হয়। ফলে বেশি
মুনাফা ও খাদ্য সংকট সমাধানে সহায়তা করে। কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাস পায়। খাদ্য ও ইউরিয়া আমদানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। এছাড়া পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে। কারণ গ্যাস আকারে নাইট্রোজেন বাতাসে ও পানিতে মিশতে পারে না।
গুটি ইউরিয়া সার তৈরিতে কোনো ঝামেলা নেই। ব্রিকেট মেশিন দিয়ে খুব কম সময়ে গুঁড়ো ইউরিয়া থেকে গুটি ইউরিয়া তৈরি করা যায়। প্রতিদিন গড়ে চার টন সার একটি মেশিন দিয়ে তৈরি করা যায়। প্রতিটি ব্রিকেট মেশিন বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় কেনা সম্ভব। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বর্তমানে ৬৫ হাজার টাকায় ব্রিকেট মেশিন তৈরি করছে। এক্ষেত্রে মেশিনের মূল্য কিস্তিতে পরিশোধেরও ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া সরকার গুটি ইউরিয়া কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।
গুটি সার ব্যবহারে যেসব উপকার পাওয়া যায়
* সাধারণ দানাদার ইউরিয়া সার জমিতে প্রয়োগ করার ফলে দেখা যায়, এসব সার গাছের মূল, পাতা বা গাছের অন্য অংশে লেগে স্থানে স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়। কিন্তু গুটি ইউরিয়া সার মাটির গভীরে প্রয়োগ করা হয় বলে এ ধরনের সমস্যার সম্ভাবনা থাকে না
* মাটির দুই থেকে তিন ইঞ্চি গভীরে প্রয়োগ করা হয় বলে সার ভেতরেই থাকে, এতে পানির স্রোতে এক জমি থেকে অন্য জমিতে সার স্থানান্তর হতে পারে না
* গুটি ইউরিয়া সার দিলে জমিতে আগাছা কম হয় এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও অনেকটা কমে যায়
* গুটি প্রয়োগের পর মাটি দ্বারা ঢেকে দেওয়া হয় বিধায় এটি অপচয় হয় না এবং গ্যাস আকারে নাইট্রোজেন বাতাসে মিশতে না পারায় পরিবেশন দূষণমুক্ত থাকে
সবজি চাষের ক্ষেত্রেও…
ধানের পাশাপাশি সবজি চাষের ক্ষেত্রেও গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহারে অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে উচ্চমূল্যের সবজি ও ফল চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে। এ সার ব্যবহারের ফলে যেমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি সবজির ফলনও বৃদ্ধি করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সবজিতে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগের নিয়ম:
বেগুন
চারা রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি গাছের গোড়া থেকে চার ইঞ্চি দূরত্বে রিং পদ্ধতিতে দু-তিন ইঞ্চি মাটির গভীরে অর্ধেক গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ৬০ থেকে ৬৫ দিন পর বাকি অর্ধেক গুটি ইউরিয়া একইভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এই সার প্রয়োগের পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে অবশ্যই হালকা সেচ দিতে হবে।
আলু
মাটির পুষ্টিমান, উর্বরতা ও আলুর জাত অনুযায়ী গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। তাই আলু চাষ করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আলু রোপণের জন্য জমি তৈরি হলে শেষ চাষে গুটি ইউরিয়া ছাড়া অন্য সার আলুর সারির দু’পাশে নালা টেনে নালায় প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর লাগানোর সময় আলু থেকে উভয় পাশে দু-তিন ইঞ্চি দূরের নালায় গুটি ইউরিয়া সার বসাতে হবে। বসানোর পর আলু ও গুটি ইউরিয়া মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
কলা
কলার জাত ও মাটির উর্বরতা অনুযায়ী গুটি ইউরিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করে নিতে হবে। কলা গাছ রোপণের ৬০ দিন অর্থাৎ দু’মাস পর, চার মাস পর এবং ফুল আসার আগে গাছের গোড়ায় যথাক্রমে ৩০, ৬০ ও ৯০ সেমি দূরত্বে পাঁচ থেকে আট সেমি গভীরে রিং আকারে প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টিএসটি ও এমওটি সারের অবশিষ্ট অংশ প্রয়োগ করতে হবে।
বাঁধাকপি ও ফুলকপি
বাঁধাকপি ও ফুলকপির চারা রোপণের ১২ থেকে ১৫ দিন পর গাছের গোড়া থেকে চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি দূরে রিং পদ্ধতিতে দুই থেকে তিন ইঞ্চি মাটির গভীরে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। এর সঙ্গে এমওপি সারও দিতে হবে।
ভুট্টা ও টমেটো চাষেও গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করা সম্ভব।
সঠিক নিয়মে সার প্রয়োগ
অন্যান্য সারের মতো যেনতেনভাবে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায় না। নিয়ম অনুসরণ করে গুটি সার প্রয়োগ করতে হয়। এ সার প্রয়োগের জন্য ধানের চারা সারি করে লাগাতে হবে। সারি থেকে সারি ও গোছা থেকে গোছার দূরত্ব হবে আট ইঞ্চি করে। ধানের চারা লাগানোর সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। তবে এই সার প্রয়োগের সময় জমিতে এক ইঞ্চি করে পানি অবশ্যই থাকতে হবে। প্রতি চার গোছার মাঝখানে তিন থেকে চার ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন গুটি প্রয়োগকৃত স্থানে পা না পড়ে।
ড্রামসিডার অথবা বপন পদ্ধতিতে চাষ করা হলে প্রতি ১৫ ইঞ্চি দূরত্বে গুটি প্রয়োগ করতে হবে। গুটি প্রয়োগের পর জমিতে সব সময় প্রয়োজনীয় পানি রাখতে হবে যেন জমি শুকিয়ে না যায়। বেলে বা বেলে-দোআঁশ মাটিতে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করা উচিত নয়।
সারি করে চারা লাগানো ধানক্ষেতে প্রতি চার গোছার মাঝখানে একটি ছোট সাইজের (০.৯০ গ্রাম) গুটি স্থাপন করলে নাইট্রোজেনের মাত্রা দাঁড়ায় হেক্টরে ২৫ কেজি, মধ্যম সাইজের গুটি প্রয়োগে হেক্টরে ৫০ কেজি এবং বড় সাইজের গুটি প্রয়োগে হেক্টরে ৭৫ কেজি। সাধারণত আউশ ও আমন ধানের জন্য ০.৯০ গ্রাম সাইজের দুটি অথবা ১.৮ গ্রাম সাইজের একটি গুটি প্রতি চার গোছার মাঝে প্রয়োগ করতে হবে। বোরো ধানের জন্য ০.৯০ গ্রাম সাইজের তিনটি অথবা ২.৭ গ্রাম সাইজের একটি গুটি প্রয়োজন হবে। বোরো মৌসুমে দীর্ঘমেয়াদি (১৫০-১৭০ দিন) জাতের ধান চাষ করলে পাঁচ-সাত দিন আগে অতিরিক্ত শতকরা ১৫-২০ ভাগ নাইট্রোজেন সার উপরিভাবে প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।