শেখ আবু তালেব: প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজের সবগুলো বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক পর্যায়ে গেলেও দুটি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত কৃষি ও এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ ঋণ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। নভেম্বর শেষে কৃষি খাতে মোট বরাদ্দের অর্ধেক ও এসএমইতে প্রায় ৪৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর শেষে কৃষিঋণ বিতরণ হয় দুই হাজার ৫৭৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে এ পর্যন্ত মোট বরাদ্দের ৫১ দশমিক ৫৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
অপরদিকে গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএমই খাতে বিতরণ করা হয়েছে আট হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
জানা গেছে, করোনা মহামারিতে পর্যুদস্ত অর্থনীতি ও ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। ১৯টি প্যাকেজের আওতায় প্রায় এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ তহবিল গঠন ও সহায়তা গঠন করা হয়। এর মধ্যে কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের জন্যও ঋণ তহবিল গঠন করা হয়।
কিন্তু এ দুটি খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো শুরু থেকেই আগ্রহ কম দেখিয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও ব্যাংকগুলো তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত মূল্যায়ন সংলাপের সমালোচনা করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতে এ পর্যন্ত মোট ব্যাংকের ৪৩টি বিতরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। ব্যাংকগুলো শুধু নভেম্বর মাসেই ১৬ হাজার ৪৩৮টি আবেদন গ্রহণ করে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ১৯১টি ঋণ আবেদন মঞ্জুর করে। এর মাধ্যমে ৩০৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।
আর প্যাকেজ ঘোষণার পর থেকে কৃষিতে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মোট এক লাখ ৯ হাজার ৬২৩টি আবেদন গ্রহণ করে। এর মধ্যে মঞ্জুর করা হয় এক লাখ সাত হাজার ৯১৭টি আবেদন। বিতরণকৃত ঋণের উপকারভোগী কৃষক ও কৃষি ফার্মের সংখ্যা হচ্ছে এক লাখ ছয় হাজার ২০৭।
অপরদিকে এসএমই খাতে গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের উপকারভোগীর সংখ্যা হচ্ছে ৬৬ হাজার ৯৬৩ জন উদ্যোক্তা ও কোম্পানি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের মৌসুমেই বছরজুড়েই কৃষকদের মাঝে কৃষিঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। আবার করোনাকালে কৃষি খাতের জন্য পৃথক ঋণ প্রণোদনা বরাদ্দ করা হয়। এজন্য এ ঋণের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম। আবার কৃষি উপখাতের মধ্যে মৎস্য ও পশু খাদ্যেও ঋণ চাহিদা তেমন ছিল না। এজন্য কৃষিঋণ বিতরণ একটু কম হয়েছে।
এসএমই ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, ছোট আকারের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ব্যাংকের যোগাযোগ কম। এ কারণে আবেদনকৃত ঋণের বিপরীতে অনেকেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি, আবার শর্ত পরিপালন করতে পারেননি। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিকল্প উপায়ে এমআরএ বা পিকেএসএফ-জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ১৭ ডিসেম্বর এ খাতে ৩০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। বাস্তবায়নের হার ৯২ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এর মধ্যে চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) হিসেবে দেয়া হয় ২৪ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণের বেশিরভাগ পায়। শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হিসেবে জুন মাসে দুই হাজার ৫০০ কোটি ও জুলাই মাসে দুই হাজার ৯০৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের জন্য বরাদ্দকৃত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে চার দশমিক ৬০ বিলিয়ন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান স্থিতি রয়েছে শূন্য দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এ খাত থেকে বিতরণকৃত ঋণের কিছু অংশ এরই মধ্যে ফেরত আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ তহবিল থেকে ঋণ নেয়া ও পরিশোধ দুভাবেই চলছে।
গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে (এনবিএফইআই) ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ৭০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে ২৬টি আবেদনের বিপরীতে।
জানা গেছে, প্রণোদনার ঋণ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোর আমানত, ঋণ বিতরণের পরিমাণ ও খাত, শাখা সংখ্যা ও তহবিল ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী, সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, দেশে কার্যরত ৯টি বিদেশি ব্যাংকের স্থানীয় শাখাগুলোকে সিএমএসএমই খাতে মোট ১৯৪ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সিএমএসএমই খাতের ঋণগুলো সাধারণত ছোট আকারের হয়। ঋণ মঞ্জুরসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া অন্যান্য বড় আকারের ঋণ মঞ্জুরের মতোই। এতে বেশি কাজ করতে হয়। এজন্য এ খাতের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখায় না খুব একটা। অন্যদিকে শুধু মৌখিক ভর্ৎসনা ছাড়া তেমন শাস্তির প্রক্রিয়ায় যায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে অতীতেও অধিক মুনাফার করপোরেট ঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে, প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ বাস্তবায়ন না করলে ব্যাংকগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তবে কী শাস্তি দেওয়া হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়নি। শুধু জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহƒত হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং কমিয়ে দেওয়া।
সিএমএসএমই খাতের ঋণ বিতরণে বেসরকারি খাতের প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি ও ইসলামি ধারার জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৭০ কোটি টাকার। এছাড়া ৫৮৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মাধ্যমে।
এ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে সাড়ে চার শতাংশ সরকার দেবে, বাকি সাড়ে চার শতাংশ ব্যাংককে দেবেন উদ্যোক্তারা। এ ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট রিস্ক গ্যারান্টি স্কিম ঘোষণা করে।