মারুফ হোসেন: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে কৃষি পর্যটন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেখানে কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি পর্যটনের বিকাশ এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে এ দেশে পর্যটন শিল্প জনপ্রিয় শিল্পে পরিণত হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। অনেকে ঘুরে বেড়ানোকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে নিচ্ছে। তাই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সবসময় পর্যটকদের পদচারণ লক্ষণীয়। এ দেশে কৃষি পর্যটন বিকাশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এ শিল্প বিকশিত হলে দেশের অর্থনীতি যেমনি এগিয়ে যাবে, তেমনি বেকারত্বের হারও কমে যাবে। বর্তমানে কৃষি পর্যটন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে পর্যটকরা সহজে মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারছেন। বিষমুক্ত, তাজা ফলমূল, শাকসবজি সংগ্রহ করতে পারছে তারা। কৃষি পর্যটনে একজন পর্যটকের জন্য বাগান বা ফার্ম থেকে নিজ হাতে পেড়ে তাজা ফলমূল খাওয়া এবং পরিবারের জন্যও কিনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
কৃষির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় কৃষি পর্যটন। কৃষি যে সম্মানিত পেশা তা কৃষি পর্যটন আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়। বাজারে গিয়ে একজন ক্রেতা মাছ কিনতে পারে ঠিকই কিন্তু কৃষি পর্যটন একজন ক্রেতাকে মাছ কেনার পাশাপাশি মাছ ধরারও সুযোগ করে দেয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন ফার্ম, খামারবাড়ি গড়ে উঠলেও কৃষি পর্যটন তেমন বিকাশ লাভ করেনি। উদ্যোক্তারা চাইলে তাদের খামার পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত করে দিতে পারে। এতে তাদের পণ্য খামারেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতার পেছনে তাদের ছোটা লাগছে না বরং ক্রেতাই তাদের পণ্য ক্রয়ের জন্য এগিয়ে আসছে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই লাভ। বাজারে যে দামে পণ্য বিক্রি হয় তার চেয়ে কম দামে তাজা, টাটকা শাকসবজি সংগ্রহ করতে পারছেন পর্যটকরা।
কয়দিন আগে একটি নার্সারিতে বেড়াতে যাই। দেখলাম সেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ বেড়াতে এসেছে। অনেকে ছোট ছোট গাছে ফুল দেখে, বিমুগ্ধ হয়ে ছবি তুলছে! আবার কেউ কেউ সেখান থেকে চারাগাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কৃষি পর্যটন আমাদের শেকড়ের দিকে নিয়ে যায়। এটি পরিবারের সবার মাঝে মিষ্টি বন্ধন সৃষ্টি করে। বাবা-মা, ভাই-বোন প্রকৃতির সঙ্গে কৃষির সঙ্গে তাদের সময় অতি মধুর ও প্রাণবন্ত করে তোলে। শহরের ইট-পাথরের দেয়াল থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে এসে পর্যটন কেন্দ্রে বা খামারে নিজ হাতে জাল মেরে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, গাছে ওঠে ডাব পেড়ে খাওয়া, ফ্রেশ ফলমূল খেতে পারা সত্যিই পরিবারের জন্য একটি আনন্দদায়ক বিষয়। কৃষি পর্যটন আমাদের সে আনন্দটুকু উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়।
কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি অবহেলিত হলেও কৃষি পর্যটন; কৃষি ও কৃষককে আরও সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এ শিল্পকে কাজ লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। যারা অন্যের কাজ না করে, মানুষকে কাজ দেবে বলেÑসংকল্প করেছে তাদের জন্য এটি হতে পারে সোনায় সোহাগা। কোনো তরুণ যদি পর্যটনকেন্দ্রিক করে তার কৃষি খামারটি গড়ে তুলতে পারে, সেখানে পর্যটকদের সমাগম হবে। ফলে গ্রামের চাকরিপ্রত্যাশী কিংবা বেকার যুবকদের কর্মের সুযোগ হবে; তাদের কর্মের সন্ধানে ঢাকা শহরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই রাজধানী ঢাকাকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, বিভিন্ন প্রকার দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম প্রভৃতির শিকার হয়ে থাকতে হচ্ছে বছরের পর বছর। কৃষি পর্যটন গ্রামে ছড়িয়ে গেলে কর্মসংস্থান গ্রামকেন্দ্রিক করা সহজ হবে। মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে গ্রামের দিকে ছুটবে। পর্যটন বহুমাত্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। আশার কথা হলো, দেশে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে ফুলের বাগান তৈরি করছে। কেউ কেউ শাকসবজির বাগান দিচ্ছে। অনেক নারী হাঁস-মুরগি, গরুর খামার দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন; যা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প হচ্ছে।
কৃষি পর্যটনের প্রসার ঘটলে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। একদিকে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে পর্যটকরা। কৃষি পর্যটনে এনে নতুন প্রজšে§র কাছে কৃষির আদ্যোপান্ত তুলে ধরে, কৃষি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করা যাবে তাদের। পুষ্টিকর খাবার আমাদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক মানসিক প্রশান্তিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৃষি পর্যটনে এলে আমরা দুটিই পাচ্ছি। যেন রথ দেখা কলা বেচা! কৃষি পর্যটন আগ থেকে চলে এলেও আমাদের দেশে এটি অনেকটাই নতুন। এখন এ শিল্পটি দেশে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। অনেক কৃষক কৃষি পর্যটনে আগ্রহী হচ্ছেন। এটির ধারণা যেন নতুন উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় তার জন্য দরকার বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন কলেজ শিক্ষার্থীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার একটি গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, তিনি একটি ফুলঘর গড়ে তুলেছেন। যেখানে শোভা পাচ্ছে দেশি-বিদেশি হাজার রকমের ফুল। যা দেখতে ও ফুল সংগ্রহ করতে পর্যটকরা সেখানে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তরুণদের গাছগাছালির নার্সারি, ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী হতে দেখা যায়। তাদের মাঝে যদি কৃষি পর্যটনের ধারণা ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে এ শিল্পে তরুণদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো বেকারত্ব। কৃষি পর্যটনের বিকাশ ঘটলে এ সমস্যাটি অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করি। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির গতিও ত্বরান্বিত হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া