কেঁচো সার উৎপাদনে সফল যশোরের তিতু

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: জৈব কৃষিতে সমৃদ্ধির নতুন সম্ভাবনায় লক্ষ্যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে মাটির গুণাগুণ ঠিক রাখতে কেঁচো সার (ভার্মিকম্পোস্ট) উৎপাদন করে সফলতা পেয়েছেন যশোরের সুলতানুজ্জামান তিতু। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামের মো. সুলতানুজ্জামান তিতু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করে দীর্ঘদিন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করতেন। সবকিছু ছেড়ে বর্তমানে ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করে চাষিদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।

সরেজমিন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তেশ্বরী নদীর পাশ ঘেঁষে ৫৬ শতাংশ জমির ওপর তিতুর দীপ্ত ভার্মি কম্পোস্ট স্টেট। তিতু জানান, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকল্পভিত্তিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্রামে এসে দেখি কৃষকরা চাষাবাদের জন্য জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। যার ফলে আমাদের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে স্থানীয়ভাবে কিছু জৈব সার তৈরি করা দরকার। এমন চিন্তা থেকেই ২০২১ সালের মে মাসে ৮০০ টাকা কেজি দরে আড়াই কেজি কেঁচো ও ৩০০ টাকা দরে ছয়টি রিং স্ল্যাব কিনে তা দিয়ে কেঁচো সার বা ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন শুরু। সবমিলিয়ে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। প্রথম উৎপাদন চক্রে (৩৫-৪০ দিনে) সার পান ৮০ কেজি এবং কেঁচোর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এরপর আরও পাঁচটি রিং স্ল্যাব যোগ করে উৎপাদিত সার প্রথমে নিজের নার্সারিতে প্রয়োগ করে এর ফলাফল দেখানো হয় স্থানীয় নার্সারি মালিক ও কৃষকদের। তিতুর গাছের চারার সবুজ পাতা দেখে অনেকে সার কেনার আগ্রহ দেখান। একজন কৃষক কিছু সার নিয়ে তার শসা ক্ষেতে প্রয়োগ করে সুফলও পান। যদিও বেশ কয়েকজন আগে থেকেই কেঁচো সারের গুণাগুণ সম্পর্কে অবহিত, কেউ কেউ দূর থেকে সেগুলো কিনে ব্যবহারও করতেন। তারাও তিতুর কাছ থেকে সার নিতে শুরু করেন। এরপর স্থানীয় কয়েক কৃষক ধানক্ষেতে, পানের বরজ ও নার্সারিতে কেঁচো সার প্রয়োগ করে সুফল পান। বিষয়টি অন্যদেরও আকৃষ্ট করে। চাহিদা বাড়তে থাকায় ১১টি রিংয়ের সঙ্গে আরও ১১টি যুক্ত করে ২২টি স্ল্যাবে সার উৎপাদন শুরু করি। উৎপাদিত সার দুই দিনেই শেষ হয়ে যায়। তখন কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারি না।

দিনদিন চাহিদা এবং সারের পরিচিতি বাড়তে থাকায় সারের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে তৈরি করা হয়েছে চারটি হাউস; এখন প্রতি চক্রে উৎপাদন তিন টন। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে নতুন আঙিকে যৌথভাবে সার উৎপাদনে শুরু করেন তিতু। বর্তমানে তার সঙ্গী হয়েছেন চাচাতো ভাই ইফতেখার সেলিম অগ্নি। পার্বত্য অঞ্চলে যার কাজু বাদাম, মাল্টা, চুই ঝাল, সজনে ইত্যাদি বাগান রয়েছে। সেখানে বছরে তার ৪০০-৫০০ টন কেঁচো সার লাগে।

তিতু বলেন, দিন দিন চাহিদা বাড়ায় একরকম বাধ্য হয়ে বেশি মাত্রায় উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছি। মে ও জুন মাস নাগাদ আমরা ১২ টন সার বিক্রি করেছি। এখন চাহিদা আরও বেশি। কিন্তু দিতে পারছি না। বেশি মাত্রায় উৎপাদনে ইতোমধ্যে চারটি শেডে ২৪টি হাউস করা হয়েছে। প্রতিটি হাউস ১২০ ঘন ফুট (প্রস্থ ৪ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও এক ফুট গভীরতা)। প্রতি ঘনফুটে ১৩-১৪ কেজি গোবরের বিপরীতে ১১ কেজি সার উৎপাদন হয়। প্রতি ১০০ কেজি গোবরে এক কেজি পরিমাণ কেঁচো গড়ে ৩৫-৪০ দিনে সারে রূপান্তরিত হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিতু জানান, আমি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। পুকুরের পানিতে এই সার প্রয়োগে অণুজীব (ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন, যা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়) তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখে।

তিতু জানান, আমাদের গ্রামবাংলায় বাড়ি বাড়ি গরু পোষা একটা ঐতিহ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু খামার। মোটামুটি লোকাল কমিউনিটি থেকে গোবর সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে বেশ কিছু গোবর ব্যবসায়ী, কমিউনিটিতে বস্তা রেখে নির্দিষ্ট দাম দিয়ে এবং নিজস্ব গাড়ির মাধ্যমে গোবর সংগ্রহ করা হয়।

তিতু বলেন, গোবর প্রসেস, হারভেস্ট, প্যাকেটজাত ইত্যাদি করতে বছরে কমপক্ষে আটটি চক্রে সার পাওয়া যাবে। আগামী শীতকাল থেকে প্রতি উৎপাদন চক্রে ৪২ টন করে সার উৎপাদন করা যাবে। সেক্ষেত্রে ৫০ টন গোবর প্রয়োজন পড়বে।

গ্রামের কৃষক টিটো গাজী বলেন, ২০ শতক জমিতে ওলকচু চাষ করেছি। তিন দফায় জমিতে ফসফেট, পটাশ ও ইউরিয়া সার দিয়ে খরচ হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। এ বছর কেঁচো সারের সঙ্গে দুই কেজি পটাশ, দুই কেজি ফসফেট দিয়ে খরচ হয় ৮২০ টাকার মতো। ইতোমধ্যে গাছের উচ্চতা এবং পাতার পুরুত্ব দেখে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এবার উৎপাদন গতবারের দ্বিগুণ হবে।

তিতু-অগ্নির যৌথ প্রতিষ্ঠান দীপ্ত ভার্মিকম্পোস্ট স্টেটে তিন ধরনের কেঁচো ব্যবহার করা হচ্ছে। একেকটি কেঁচো আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা। এর মধ্যে একটি গোলাপি রঙের, অন্যটি কালো, আরেকটি মোটা ও লালচে। এদের মধ্যে গোলাপি কেঁচো সবচেয়ে ভালো। এগুলোর দামও বেশি, কেজি প্রতি ১২০০ টাকা। অন্যান্য কেঁচোর কেজি প্রায় এক হাজার টাকা। প্রক্রিয়াজাত গোবর এবং কেঁচোর সন্নিবেশের ফলে এই সারের উৎপাদন হয়। কেঁচো সার মূলত কেঁচোর বিষ্ঠা।

মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আবু হাসান বলেন, মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকে। কিন্তু বেশি বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে তা এখন দুই শতাংশের নিচে নেমে গেছে। মাটির পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে জৈব সারের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে কেঁচো সার সেরা। আমরা কৃষকদের এ সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছি। তিনি বলেন, দীপ্তভার্মি কম্পোস্ট স্টেটটি আমার দেখামতে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এত বড় ফার্ম আর নেই। তিতুর চিন্তাধারা বেশ পরিপক্ব, সুন্দর ও পরিকল্পিত। আমরা তাদের টেকনিক্যাল কিছু সাপোর্ট দিয়েছি, অর্থনৈতিক কোনো সাপোর্ট দিতে পারিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০