Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 7:21 pm

কেউ রাখে না শতবর্ষী খবরের ফেরিওয়ালার খবর

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর:‘লাখো মানুষের সুখ-দুঃখের খবর ফেরি করেছি। কিন্তু আমার কষ্টের খবর কেউ ফেরি করে না’আক্ষেপ করে বলছিলেন লক্ষ্মীপুরের সৈয়দ হকার। ১১১ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মদ। পেশায় তিনি ছিলেন একজন পত্রিকা বিক্রেতা। ৮০ বছর ধরে লক্ষ্মীপুরের পথেঘাটে পত্রিকা নিয়ে হাজির হতেন মানুষের ধারে। স্থানীয়ভাবে সৈয়দ হকার নামে পরিচিত ব্যক্তিটি জীবনের ৮০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে। এদিকে স্থানীয় পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশে সবচেয়ে আদি পত্রিকা বিক্রেতা সৈয়দ আহম্মদ।

তার পুরো নাম সৈয়দ আহম্মদ ভূঁইয়া। জাতীয় পরিচয়পত্রে জš§ তারিখ ১ মার্চ ১৯১১ সাল। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগরের মকরম আলীর ছেলে সৈয়দ আহম্মদের জীবিত ৬ ছেলে ও মেয়েরাও ষাটোর্ধ্ব। ছেলেদের কোনোভাবে সংসার চললেও ষাট বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্ত দুই মেয়ে আর শতবর্ষী স্ত্রীসহ চারজনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব এখনও তার ঘাড়ে। নিজ ও স্ত্রীর বয়স্ক ভাতা ছাড়া অন্য কোনো আয় নেই তার।

তবু সৈয়দ আহম্মদ হকার এখনও লাঠিতে ভর করে লক্ষ্মীপুর শহরে ঘুরে বেড়ান জীবিকার সন্ধানে। চোখে ঠিকমতো না দেখলেও তিন বেলা আহারের খোঁজে প্রতিদিনই বের হন পথেঘাটে। পুরোনো পত্রিকার গ্রাহকরা তাকে দেখলে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে লক্ষ্মীপুর শহরে তার অতীতের কর্মস্থল রহমানিয়া প্রেসে কথা হলে এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরেন। এ সময় নানা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখতে দেখতে চোখের দুই কোণে পানি গড়িয়ে পড়ে তার।

প্রবীণ সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী জানান, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা, এর আগে লক্ষ্মীপুর থানার সব সময়ের হাজার ঘটনার সাক্ষী ছিলেন খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেয়াই ছিল তার কাজ। বাম হাতে একটি লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি; ডান হাতে পত্রিকা নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি। এখন তার সময় যাচ্ছে কষ্টে।

লক্ষ্মীপুর পত্রিকা হকার সমিতির সভাপতি আনোয়ার জানান, পত্রিকার আয়ে তার সংসার চলত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করতে পারছেন না তিনি।

সৈয়দ হকার জানান, কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে নৌকায় কাজ করতেন। এরপর স্থানীয় এক মাওলানার সহযোগিতায় প্রায় ৮৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ইংরেজ আমলে ভারতীয় ‘পয়গাম’ পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পরে ‘আজাদ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘যুগশঙ্খ’ আর ‘সংবাদ’ পত্রিকা বিক্রি করতেন। দুই পয়সা, চার পয়সায় পত্রিকা বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি।

সৈয়দ আহম্মদ জানান, ‘সে সময়ে ছোট এ লক্ষ্মীপুরে সরাসরি পত্রিকা আসত না। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রেলগাড়িতে পত্রিকা আসত। সেখান থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুরে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। তারপর তা পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত প্রকাশের তিন-চার দিন পরে। প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব হতো না।’ তিনি আরও জানান, কিছু সময় ডাকহরকররা হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। তখনও সকালবেলার পত্রিকা আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন তিনি।

এভাবে নিজের অজান্তেই পত্রিকার সঙ্গে নিজের জীবনকে পুরো জড়িয়ে নেন সৈয়দ আহম্মদ। তারপর টানা প্রায় ৮০ বছর পত্রিকা বিক্রির সঙ্গেই ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর থেকে আর পত্রিকা বিক্রি করতে পারছে না। কিন্তু অভ্যাসের কারণে প্রায় প্রতিদিনই এজেন্সিতে আসেন তিনি। পত্রিকা না পড়তে পারলেও উল্টেপাল্টে দেখেন।’

মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে সৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। প্রথম দিকে নিজে নিজে পত্রিকা বিক্রি শুরু করলেও এক সময় ছৈয়দ আহম্মদের প্রধান আশ্রয়দাতা হন লক্ষ্মীপুরের প্রয়াত সাংবাদিক ও রহমানিয়া প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক গোলাম রহমান।

রহমানিয়া প্রেসের পরিচালক রাকিব হোসেন জানান, ‘ছোটবেলা থেকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসতেন সৈয়দ চাচা। মাঝে মধ্যে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখতাম সৈয়দ কাকা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেক সময় রাত পর্যন্তও তিনি পত্রিকা বিক্রি করতেন।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যে মানুষটি আজীবন মানুষের নিকট জ্ঞান বিক্রি করেছেন, সমাজ আলোকিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তার শেষ দিনগুলো যাচ্ছে চরম কষ্টে। বিগত আট দশকের খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ হকার এখন বার্ধক্য আর রোগশোকে খুবই ক্লান্ত। এখন তার জীবন চলছে অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে। এক ছেলে আবুল কালাম (৬০) বাবার পেশা পত্রিকা বিক্রি ধরে রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পত্রিকা বিক্রির পয়সায় তারও সংসার চলে না।

লক্ষ্মীপুর শহরের ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন পাঠান জানান, ‘স্কুলজীবন থেকেই তিনি সৈয়দ আহম্মদকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখেছেন। তার বাবাও দেখেছেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বিনে পয়সায় তাকে পত্রিকা পড়তে দিতেন।’

শতবর্ষের এ আলোকিত মানুষটির জীবনে সব সময়ই নিত্যদিন সঙ্গী হচ্ছে অভাব। তবু তিনি অত্যন্ত বড় হৃদয়ের মানুষ। এ আলোর ফেরিওয়ালা সৈয়দ হকারের জীবনের শেষ দিনগুলো কি এভাবে পথেঘাটে আর কষ্টে যাবে? এমন জিজ্ঞাসা সচেতন মহলের।