Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 8:50 pm

কেএনএফের সঙ্গে সংলাপ সম্ভব নয়

প্রতিনিধি, বান্দরবান: দুই দিনে বান্দরবানের তিন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফের নাম আসায় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া আর ‘সম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীগুলোর সদস্যদের নিয়ে গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা।

গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কমিটি মনে করে, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে সংলাপ করার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।’

কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ২০২৩ সালের ৩০ মে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। ওই বছরের জুলাই ও আগস্টে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের দুবার ভার্চুয়াল আলোচনাও হয়। পরে ৫ নভেম্বর রুমা উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মতো কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মতো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

‘শান্তি আলোচনা’ শুরুর পর পাহাড়ে হত্যা-সহিংসতা থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল পাহাড়ের মানুষের মনে। এরই মধ্যে গত মঙ্গল ও বুধবার বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা ব্যাংক থেকে টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং এক ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি।

রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা-ডাকাতি এবং ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে অপহরণের ঘটনাটি মঙ্গলবার রাতে প্রথম ভাগে ঘটলেও থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে হামলা হয়েছে ভরদুপুরে। দুটি ঘটনাতেই পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নাম এসেছে, যারা পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। এ ঘটনায় কেএনএফের সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও জানিয়েছেন।

এ প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডাকে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। এ কমিটির আহ্বায়ক বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা মারমা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘অতিসাম্প্রতিক ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি তীব্রভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এসব ঘটনায় চলমান সব ধরনের প্রচেষ্টা পদানত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।’

কেএনএফ সংলাপ করার পথ ‘বন্ধ করে দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আগামতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

ব্যাংকে হামলা ও অপহরণের ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে নিন্দাও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

কমিটির আহ্বায়ক বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য গত বছর ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অরুণ সারকি টাউন হলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। পরে জুনে বিভিন্ন জাতিসত্তার সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিং হয়। সবার মতামতের ভিত্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার সুযোগ হয়। গত বছর ৫ নভেম্বর এবং এ বছর মার্চে সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফ সব ধরনের সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা এবং অন্যান্য বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারকে সই করে বলে জানান ক্য শৈ হ্লা মারমা।

কিন্তু তারা চুক্তি ভঙ্গ করে সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘কমিটির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, অপহরণ ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যায় তারা।’

সংবাদ সম্মেলনে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা, শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সচিব ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জারলমময় বম এবং কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে রুমা শাখার সোনালী ব্যাংকের অপহƒত ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তাকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে রুমার ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) দিদারুল আলম জানিয়েছেন।

সোনালী ব্যাংক বান্দরবান শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে সোনালী ব্যাংকের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি শাখার সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে অন্যান্য উপজেলা শাখার কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমায় কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছুসংখ্যক লোকজন রয়েছে, যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।

কেএনএফের ফেসবুক পেজে তারা জানায়, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদমসহ ৯টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে। পরবর্তী সময়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ।

সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে বলে ২০২২ সালে অক্টোবরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব।