জয়নাল আবেদিন: বর্তমানে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মোট শাখার সংখ্যা ৩৮৩টি। দুর্নীতির খবর পেয়ে সবগুলো শাখার মধ্যে রাকাবের মাত্র ১২টি শাখায় পরিদর্শন পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই বেরিয়ে এসেছে বিশেষায়িত এই ব্যাংকটির ১৫ ধরনের গুরুতর অনিয়ম। এর মধ্যে সরকার ঘোষিত করোনা ভর্তুকি না দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে জোরপূর্বক সুদ আদায়, খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন ও ভুল সিআইবি রিপোর্ট প্রেরণ, স্থগিতকৃত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর এবং নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো ঋণ সমন্বয় অন্যতম।
বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের ঋণ-সংক্রান্ত তথ্য সিআইবি ডাটাবেজে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব গ্রাহকের মধ্যে নওহাট জুট মিলস লিমিটেড, মেসার্স তৌহিদ ট্রেডার্স, মেসার্স পিন্টু এন্টারপ্রাইজ এবং পিয়াস ট্রেডিং উল্লেখযোগ্য। ডিপোজিট স্কিমের বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণগুলো সঠিক রিপোর্টে উপস্থাপন করা হয়নি। এর মাধ্যমে প্রভিশন সংরক্ষণে সুবিধা নিয়েছে ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, করোনাকালীন সময়ে কৃষকদের ঋণের বিপরীতে সুদের ওপর ভর্তুকি দেয় সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ-সংক্রান্ত একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করলেও সেই নির্দেশনা অমান্য করেছে রাকাব। অসংখ্য গ্রাহককে সুদ ভর্তুকি না দিয়ে আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত টাকা। এছাড়া স্থগিতকৃত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর করেছে রাজশাহীর স্থানীয় মুখ্য কার্যালয়, বাঘা শাখা, জয়পুরহাটের কালাই শাখা ও রংপুরের মিঠাপুকুর শাখা। এসব শাখার মাধ্যমে ব্যাংকের সার্বিক আয়ের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়েছে। তারপরও ২০২০ সালে ৬০৩ কোটি টাকার লোকসানে রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত অনুযায়ী লোকসানের পরিমাণ ৬১৭ কোটি। এই লোকসান পোষাতে দীর্ঘদিন থেকেই ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। ভর্তুকির টাকায় কৃষকের কোনো উপকার না হলেও পকেট ভরছেন কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আর্থিক সহায়তা হিসেবে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপর আবারও ৮৭৩ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা চেয়েছে রাকাব। মূলধন ঘাটতি, পুঞ্জীভূত লোকসান, খেলাপি ঋণের উচ্চহার ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ডুবতে বসেছে বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। তাই ভর্তুকি দিয়েও লোকসান সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকটি পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেও সেগুলো যথাযথ পরিপালন করতে পারছে না। ফলে রাকাবের সার্বিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, একই গ্রাহকের কাছে একই দিনে ঋণ সমন্বয় ও বিতরণ করেছে রাকাবের বাঘা শাখা। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুদাসলে ঋণের টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে ঋণসীমা বৃদ্ধি করে নতুন ঋণ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ঋণের টাকা দিয়ে পুরোনো ঋণ সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে করে ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যাংকের প্রকৃত গ্রাহক। রংপুরের মিঠাপুকুর শাখার ক্লাসিফাইড লোন (সিএল) টপশিট এবং ওয়ার্কসিটের মধ্যে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দুই শিটের মধ্যে ৪১ লাখ টাকার অধিক গরমিল পাওয়া গেছে। এছাড়া দশ বছর ও তারও বেশি সময় ধরে লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১১৫টি হিসাবের এক টাকাও জমা করেনি রাকাব, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ব্যাপক অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের (২০২০) জুন পর্যন্ত রাকাবের নিট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আগের বছরের (২০১৯) জুন শেষে যার পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি ২১ লাখ টাকা। যদিও চলতি বছরের মার্চ শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে এক হাজার ৫১৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
অন্যদিকে রাকাবের কিছু কর্মকর্তাকে অবৈধ পদোন্নতির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে আবেদন করেছেন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল হোসেন। চলতি বছরের মে মাসে সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠিতে রাকাবের বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উপমহাব্যবস্থাপক ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদ ছাড়া অন্যান্য সব পদের সরাসরি সাক্ষাৎকার ব্যতীত ২০২০ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক পদোন্নতির আবেদন করেছেন এমডি; যা পদোন্নতি নীতিমালার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৫৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা; যা ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। বাড়ছে রাকাবের লোকসানি শাখার সংখ্যাও। মোট ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ১১৮টিই লোকসানি শাখায় পরিণত হয়েছে বিশেষায়িত এ ব্যাংকের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকাবের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের বিশেষ কোনো পরিদর্শন হয়েছে কিনা, তা আমার জানা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুটিন পরিদর্শন করেছে কিনা তাও বলতে পারছি না।’ পদোন্নতির আবেদনের বিষয়টি স্বীকার করে ইসমাইল হোসেন বলেন, এটা আমার একার সিদ্ধান্ত নয়। এটা পর্ষদের সিদ্ধান্ত। তবে এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এখনও কিছু জানানো হয়নি।