নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। হোটেলে বসে ব্যাংকের সিআরআর এসএলআর কমানোর সিদ্ধান্ত হয় কী করে? শুধু তা-ই নয়, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গতকাল রোববার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ’ আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ঋণখেলাপিদের ধারাবাহিকভাবে সুযোগ দেয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য এগুলো ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশের বড় অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু শাস্তি হয় ছোট কর্মকর্তাদের। আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানে ছোট-বড় সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। দেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধি। কিন্তু বাজারে তো এর প্রভাব দেখছি না। আমদানি পণ্য বা মূলধনি যন্ত্রপাতি যাচ্ছে কোথায়। উৎপাদন বাড়ছে না কেন?
বাংলাদেশ খাদের কিনারে পড়ে গেছে, এটা ভাবা ঠিক হবে না। তবে সংকট তৈরি হয়েছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি অনুভব করেছেন এবং উদ্যোগও নিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতিতে লৌহ ত্রিভুজ গেড়ে বসেছে। এই লৌহ ত্রিভুজ হলো, একমাত্রিক উন্নয়ন দর্শন, স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি বা ব্যবস্থাপনা এবং সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এক ধরনের অবিচার।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট অবিচারের চেহারা দেখা যাচ্ছে। নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যাহত হলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড প্রভৃতি ক্ষেত্রে। এছাড়া হাউজিং খাতেও বেশ কিছু সমস্যা হয়েছে। সরকার যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে এগোচ্ছে তাতে যুব বেকারত্ব বাড়ছে। এ রকম অবস্থায় প্রশাসনের যদি সার্বিক উন্নতি না হয় তাহলে অবিচারের নতুন দিক সৃষ্টি হবে। এ মুহূর্তে সংকট সামাল দিতে হবে। তবে ভবিষ্যৎ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার। রাজনৈতিক অর্থনীতির যে ধরনের ব্যবস্থাপনায় চলছে সেটা নিয়ে মতামত জানানোর। কারণ রাজনৈতিক অর্থনীতিতে লৌহ ত্রিভুজ গেড়ে বসেছে। সরকার একমাত্রিক উন্নয়ন দর্শন নিয়ে এগোচ্ছে, স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে যেমন কুইক রেন্টাল চালু করা, পরিবহন খাতে বিআরটিএকে কার্যকর হতে না দেয়া। অবিচারের খাটুনির বোঝা জনগণের ওপরে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতার আলোচনার পাশাপাশি এই লৌহ ত্রিভুজ ভাঙার আলোচনাও আনতে হবে। তা না হলে অর্থনৈতিক সংকট দূর হবে না।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের অর্থনীতি মধ্যমেয়াদি সংকটে পড়েছে। সংকট থেকে উত্তরণ হবে ধীরে ধীরে। এজন্য মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। তিনি বিনিয়োগ বহুমুখী করা, বাণিজ্য বাড়ানো, গ্যাস কূপ খনন, কারখানায় লোডশেডিং কমানো, ব্যাংকঋণ সহজ করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, বাজারের কারসাজি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সংকট উত্তরণের জন্য সময় উপযোগী ব্যবস্থাপনা দরকার। অর্থনীতির বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার সুযোগ রয়েছে। এমন উদ্যোগ নিতে হবে যাতে বেশিরভাগ মানুষ উপকৃত হন।
ব্যবসায়ী নেতা মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘আমরা অস্বস্তিতে আছি। এর মূল কারণ গ্যাস সংকট। এই সংকটের সমাধান না হলে রপ্তানিমুখী শিল্প সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং রপ্তানি কমে যাবে। এর ফলে অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হবে।’
অধ্যাপক মু. তামীম বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ মূল সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এগুলো বসে থাকায় ক্ষতি হচ্ছে। সম্পূর্ণ বসে আছে এমন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া ঠিক নয়। বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সাশ্রয় করা ছাড়া আমাদের এখন আর কোনো উপায় নেই।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি। একইসঙ্গে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।