Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:33 pm

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে সরকার

রোহান রাজিব: সরকারের ঋণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের চাহিদা বাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই মাস আট দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমেছে পাঁচ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। ফলে সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ সুদহারের চেয়ে ট্রেজারি বিলের সুদহার কম হওয়ায় বাণ্যিজিক ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল বন্ড কেনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই এসব ট্রেজারি বিল বন্ড কিনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ না বেড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাড়ছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাড়ানোর এ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে মূলত বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে। তবে এ নীতির ফলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই মাস আট দিনে সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের জুন শেষে সরকারের ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে প্রথম দুই মাস আট দিন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুনের তুলনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ আট হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থিতি বেড়ে হয়েছে ৬৪ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য ও জ্বালানি বাজারের অস্থিরতাসহ নানা কারণে জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে সরকার ব্যয় সংকোচনের দিকে বেশি মনোযোগী হয়। এদিকে অর্থবছরের প্রথম মাসে রাজস্ব আয়েও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং বিদেশি অনুদান ও ঋণ বেড়েছে। এ দুয়ের প্রভাবে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ কম নিচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার যে ঋণ নিয়েছে, শেষ মাস জুনেই নিয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ঋণ ছিল ২৬ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। আর জুনে ঋণ নেয়া হয় ৪৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ৭৬ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার নেয় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নেয় ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যার অন্যতম কারণ রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। তবে প্রথম মাসে মাত্র ২৯৩ কোটি টাকার ঋণ এসেছে এ খাত থেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, সরকারের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখিতা বজায় থাকলে মূল্যস্ফীতির ওপর একটা চাপ তৈরি হবে। তিন মাস দিয়ে বিবেচনা করা যাচ্ছে না, আসলে এটা দীর্ঘমেয়াদি কিনা। এটা সাময়িক হলে সমস্যা হবে না, তবে দীর্ঘমেয়াদি হলে সমস্যা তৈরি করবে।

তিনি বলেন, ট্রেজারি বিলে সুদের হার বেড়ে গেছে। সরকার যদি ব্যাংকের কাছে ট্রেজারি বিল বিক্রি করে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ঋণে একটা ভাটা পড়বে। আবার নিজে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করলে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। তাই মনে হচ্ছে, তারা দ্বিতীয় পদ্ধতির দিকে যাচ্ছে। এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ সিস্টেম। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার এখন প্রধান সংকট। এ দুটা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

জানা গেছে, এক বছর আগের তুলনায় ট্রেজারি বিল বন্ডে দ্বিগুণেরও বেশি সুদ পাওয়ার পরও অনেক ব্যাংকের এখন সরকারের ঋণ দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই। বরং সংকট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য ব্যাংক থেকে ধার করছে। গতকাল কলমানিতে ছয় হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এছাড়া সংকটে থাকা কিছু ব্যাংকে তিন হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার তারল্য সহয়তা দিয়েছে। চলতি বছরের জুলাই শেষে ব্যাংক খাতে মোট তারল্য ছিল তিন লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ২৯৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর গত অর্থবছর ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগে ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি জুলাই মাসে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে উঠেছে, যা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য রাখা হয়েছিল ১৩ শতাংশ ৬০ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি ৪৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধারের সুদ বা রেপো হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করে দিয়েছে।