ব্যাংক কমিশনের বিষয়ে সিপিডি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। ব্যাংক খাতের এ দুরবস্থার অবসানে সরকার কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা করছে। কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও নাগরিক সংলাপকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে কমিশনের নেতৃত্বে যদি যোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন না হয় এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে সে কমিশন কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করে সিপিডি। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে বিভিন্ন নীতির প্রয়োগ ঘটাতে না পারায় ব্যাংক খাতে এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে এ খাত এখন গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও মনে করছে সিপিবি।

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সিপিডির কর্তাব্যক্তিরা। সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক খাত সঠিকভাবে পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নীতিমালা রয়েছে, তার বরখেলাপ হচ্ছে। এসব নীতি সঠিকভাবে পরিপালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করছে না, যার ফলে বিপুল অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসনের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের যে উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।’ তবে এ কমিশনের কার্যপরিধি এবং কেমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে কমিশন গঠন করা হবে, তার ওপর অনেকখানি কমিশনের সার্থকতা নির্ভর করছে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে সিপিডি কমিশনের কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে একাধিক কমিশনে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও তার নিজের অংশগ্রহণ ছিল বলে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে ফলপ্রসূ, বাস্তবোচিত ও টেকসই সমাধান দিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত কমিশন কীভাবে কাজ করবে, তা নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, কমিশন কি কেবল ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে কাজ করবে, নাকি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মপরিধির আওতা আসবে; ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে প্রাধান্য দেওয়া হবে, নাকি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকেও সংস্কার আনা হবেÑএসব বিষয় নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি ব্যাংক দ্বারা প্রভাবিত খাত হিসেবে পুঁজিবাজারের বিষয়টি কমিশনের আওতায় আসবে কি না এবং কমিশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কীভাবে দেখবেÑসেসব বিষয় নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে কমিশন কিছু করবে কি না, সেসব বিষয় তার কর্মপরিধির মধ্যে নির্দিষ্ট থাকতে হবে।

ব্যাংকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা অসহায় আতঙ্ক নিয়ে একটা ভয়ংকর ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজের ক্ষমতা ও সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ ব্যাংক খাতের দুরবস্থা অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বিবর্তন হয়ে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যার পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমানে রাজনৈতিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এ জন্য এ খাতের সংস্কারে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের নির্দেশনা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রস্তাবিত কমিশন একটি সাময়িক কমিশন হিসেবে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আগামী বাজেটকে সামনে রেখে আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে এই ব্যাংকিং কমিশনের একটি অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দেওয়া উচিত। কমিশনের স্বাধীনভাবে কাজের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনদের মতামত ও কার্যকর সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হবে।’

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনার জন্য সিপিডি ২০১২ সাল থেকেই একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করে আসছে। সরকারের এ উদ্যোগ যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সেটি একটি ভালো উদ্যোগ হবে। সিপিডি মনে করে, সিপিডি-সহ অন্যান্য অনেকের নিরন্তর আলোচনা ও দাবি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে।’

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত এ ব্যাংকিং কমিশনের একটি সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধি থাকা উচিত। কমিশনের কর্মপরিধির আওতায় ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের গ্রাহক ও অর্থনীতির জন্য ব্যাংক খাত কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা পরিমাপ করা উচিত। কমিশনের আওতায় ব্যাংক খাতের সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যানের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি কমিশনের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। ব্যাংক খাতের বিদ্যমান সমস্যার মূল কারণগুলো কী এবং সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা এবং ব্যাংক খাতের সমস্যার জন্য কারা এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান দায়ী, তা চিহ্নিত করাও কমিশনের কার্যক্রমের অংশ হওয়া প্রয়োজন। এসব বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী ধরনের প্রশাসনিক ও আইনগত পদক্ষেপ প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কমিশন সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা তৈরি করবে এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবেÑএটাই প্রত্যাশা।’

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, তবে এটি শর্তসাপেক্ষ। তিনি বলেন, ‘কমিশন গঠনের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা এটাকে সমর্থনও করব। কিন্তু এটার পরিধি কী হবে, কার্যক্রম কী হবে, সুপারিশমালা কী হবে, সুপারিশমালার বাস্তবায়ন কী হবে সেসব বিষয় নির্দিষ্ট হতে হবে।’ একই সঙ্গে এ কমিশন কাদের নিয়ে গঠন করা হবে, কমিশনকে কাজের স্বাধীনতা কতটুকু দেওয়া হবেÑসে বিষয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলেন তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০