বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের শেষার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করল গত রোববার। সে ঘোষণায় গভর্নর ফজলে কবির পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন, জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতির ভঙ্গি হলো ‘উৎপাদন সহায়ক সতর্ক নীতি’, যা আগের মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা। উল্লেখ্য, ওই অনুষ্ঠানে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশাও ব্যক্ত করেছেন তিনি। সেখানে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পরিমাণটি গত ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে সামান্য কম। খেয়াল করার মতো বিষয়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হলেও অর্জিত হয় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। ফলে, সম্ভবত ঋণ প্রবৃদ্ধিকে আরও বাস্তবসম্মতকরণের উদ্যোগ থেকেই নগণ্য পরিমাণে কমানো হয়েছে চলতি প্রাক্কলন। সুতরাং এটি অর্জিত হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম হতে পারে বলে আমাদের প্রত্যাশা। কথা হলো, অর্থনীতির অন্যান্য খাতে যেখানে অনেকটা অদৃশ্যভাবে ও ধীরে ধীরে মুদ্রানীতির প্রভাব পড়ে, সেখানে পুঁজিবাজারের ওপর এর মতো বৃহৎ আর্থিক হাতিয়ারগুলোর প্রভাব তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক। আর চলতি মুদ্রানীতিতে যে আমাদের শেয়ারবাজারের স্পর্শকারতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা বাজারের প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট। গতকালের শেয়ার বিজে ছাপা ‘মুদ্রানীতি আতঙ্কে পুঁজিবাজারে ধস!’ শীর্ষক খবর পড়লেই সেটা বোঝা যায়। কেবল এ দৈনিক নয়, সহযোগী একটি জাতীয় দৈনিকের প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে গতকাল প্রকাশিত দু’টি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মুদ্রানীতির প্রভাবে বড় দরপতন’ এবং ‘সূচকের দরপতন অব্যাহত পুঁজিবাজারে’।
অবশ্যই এখানে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কেননা গভর্নর মহোদয় বলেছেন, ‘২০১০ সাল থেকে বিরাজমান মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি যাতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে সুস্থধারায় থাকে, সে বিষয়ে কার্যকর নজরদারি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।’ তার এ মতের বিরোধিতা করা কঠিন। হতে পারে বাজার সংশোধনের উপায় হিসেবে তথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজিকে অধিকতর সুরক্ষা দিতেই তার এমন অবস্থান। ফলে টেকনিক্যালি পদ্ধতিটা হয়তো সঠিক। কিন্তু কথা হলো, বাজার একটু একটু করে উঠতে শুরু করছিল এখন। তদুপরি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে বিনিয়োগের ব্যাপারে এখনও ‘যথেষ্ট’ সচেতন হয়ে উঠতে পারেননি। হলে হয়তো ওই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না তারা। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের সচেতন করে তোলার উদ্যোগগুলো এখনও অফলপ্রসূ। তাছাড়া এখনও বাজারে কিছু ফাটকা উপাদান বিরাজ করছে বলে প্রতীয়মান। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল বাজারের সংবেদনশীলতাকে আমলে নিয়ে আরও সতর্কভাবে বক্তব্য দেওয়া, যেন মর্মাহত না হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। উপরন্তু তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত ছিল ফাটকা উপাদানগুলোর ওপর। আপাতদৃষ্টিতে বর্তমান মুদ্রানীতিতে এমন কিছু নেই, যা সরাসরি আঘাত করতে পারে চলতি বাজারের গতি-প্রকৃতিকে। বরং সেখানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর বাস্তবসম্মতভাবে যেভাবে জোর দেওয়া হয়েছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাজারই উপকৃত হওয়ার কথা। অথচ কিছু সাধারণ বিনিয়োগকারীর মনে এখনও যে ‘শর্ট টার্মিজম’ কাজ করছে, তা বোঝা যায় সাম্প্রতিকতম প্রতিক্রিয়া দেখে। আমরা চাইব, তাদের আরও সচেতন করে তোলা তথা বিনিয়োগ শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নিক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি বিশেষ কোনো গোষ্ঠী আবারও বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ করার মতলবে বাজারে সক্রিয় রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ২০১০-১১ সালের ‘বাজার কারসাজিকারী সন্দেহভাজন’দের অনেকেই কিন্তু বহাল তবিয়তে রয়েছে। শাস্তি না হওয়ায় তারা যে আশকারা পাচ্ছে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে?