Print Date & Time : 29 June 2025 Sunday 10:00 am

কেন বাড়ছে ডলারের দাম

মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: আমদানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সের প্রবাহে ধীরগতি আর রফতানি কম হওয়ার জন্যই টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। এর ফলে একদিকে যেমন আমদানি ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি করা পণ্যের দাম। বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি বৃদ্ধি সামাল দিতে না পারলে আরও বাড়তে পারে ডলারের দাম। তাই ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এক ডলারের দাম ছিল ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। একই বছরের নভেম্বরে যা বেড়ে হয় ৭৮ টাকা ৬০ পয়সা। ২০১৬ জানুয়ারিতে ৭৯ টাকা এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৭৮ টাকা ৭০ পয়সাতে আটকে থাকলেও এরপর অনেকটা লাগামহীন হয়ে যায় ডলারের দাম। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক হারে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এক ডলারের দাম ছিল ৭৯ টাকা। আর বর্তমানে এক ডলারের দাম ৮৫ টাকা। অর্থাৎ মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে এক ডলারের দাম বেড়েছে ছয় টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। সেইসঙ্গে রফতানি আশানুরূপ নয়, অর্থাৎ যেভাবে আমদানি বাড়ছে সেভাবে রফতানি বাড়ছে না। আবার রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও আশানরূপ নয়। এক মাসে বাড়ে তো আরেক মাসে কমে। আবার সেবা খাতের মাধ্যমে ডলার আয়ও সেভাবে বাড়ছে না। বস্তুত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অবস্থাও শোচনীয়।
বাণিজ্য ভারসাম্য না থাকা এর মূল কারণ বলে মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বাণিজ্যে ভারসাম্য না থাকার ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে। এর ফলে সরবরাহের তুলনায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বাড়ার ফলে ডলারের দামও বাড়ছে।
তিনি বলেন, চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ার কারণ হলো, আমাদের আমদানি প্রবৃদ্ধি আর রফতানি প্রবৃদ্ধির মধ্যে বিশাল ব্যবধান। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক তিন শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আর আমদানির ভিত্তিও বড়। একটা বড় বৃদ্ধির ওপর বড় প্রবৃদ্ধি। চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ার পেছনে এটা প্রধান কারণ।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংক মাঝে মাঝে চেষ্টা করে রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কিন্তু বেশি ডলার বাজারে ছাড়লে আবার সেটা রিজার্ভে প্রভাব ফেলবে। এটার মূল সমাধান হলো রফতানি বাড়াতে হবে। রফতানি বাড়লে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে আসবে এবং ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান শেয়ার বিজকে বলেন, সম্প্রতি আমাদের আমদানি অনেক বেড়েছে। আমরা এখন অনেক বেশি আমদানিনির্ভর হয়ে গেছি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোগান বাড়েনি। ফলে দাম বেড়ে গেছে। এদিকে আবার যে হারে আমদানি বেড়েছে সেই হারে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়েনি। ফলে দুটোর মধ্যে ব্যালেন্সের ঘাটতি থেকে গেছে। আর এর ফলেই ডলারের দাম বেড়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধে, অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। সেখানে রফতানি আয় বৃদ্ধির হার মাত্র ৭.৭৮ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশের মতো। জ্বালানি তেলের আমদানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং শিল্প কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। আর এতে অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর প্রথমার্ধে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বেশি।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে তিন হাজার ৩৭২ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ছয় দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে তিন হাজার ১৬২ কোটি ২৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল।
রেমিট্যান্সের প্রবাহও ভালো নয়। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছিল। যদিও চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) এক হাজার ৩৫৭ কোটি ৫১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ১৫৫ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স। আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২০২ কোটি ডলার। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৩২ কোটি ৭১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। এপ্রিলের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত মে মাসে প্রায় ১৬ কোটি ডলার বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের এই প্রবৃদ্ধি আমদানি ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, আগে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে সরবরাহ করে ডলারের ব্যালেন্স করত। কিন্তু এখন আমদানি এতই বেড়েছে যে বাজারে ডলার সরবরাহ করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে তিন হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। ডলারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১৫০ কোটির বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকের মতো মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ডলারের দর বেড়েছে। জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে মানি চেঞ্জারগুলোতে এক ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা ২০ পয়সায়।
ডলারের দাম বাড়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমদানি বাড়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এটা নির্বাচনী বছর, তাই এটা অস্বাভাবিক নয় যে আমদানির আড়ালে অর্থপাচার করা হচ্ছে। নির্বাচনী বছরে দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা থাকে। অর্থপাচার করা হয় ডলারের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে অর্থপাচার হলেও ডলারের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার ফলে ডলারের দাম বাড়তে পারে। আমদানির সঠিক মূল্য আড়াল করেও অর্থপাচার করা যায়। বিষয়টি ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে হবে। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
ডলারের দামের ধারাবাহিক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকরা। কারণ এতে করে আমদানি খরচ বেড়েছে। আমদানি খরচ বাড়ায় বেড়েছে আমদানি করা পণ্যের দামও।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। ডলারের বাজারের অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতো বাফেদাকে আইনগত ক্ষমতা দিতে হবে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বলেছি। কিন্তু আমরা ব্যাংকগুলোকে চাপ দিতে পারি না। তাই তারা তাদের ইচ্ছামতো দর নির্ধারণ করে। ডলারের অভিন্ন দর নির্ধারণের বিষয়ে বৈঠকে ব্যাংকগুলো ঐকমত্য পোষণ করলেও পরে তারা মানে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা প্রয়োজন।