Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 9:30 pm

কৈশোরকালীন পুষ্টি

শানু মোস্তাফিজ: কিছু দিন ধরে রাতে ঘুমের মধ্যে ইশরাত মিমের (১৩) হাতের আঙুলগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় তার ক্লান্ত লাগে। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে সে। পড়ালেখায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। নিয়মিত স্কুল যেতে তার সমস্যা হয় প্রভৃতি। এ অবস্থায় তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করে বলেন, ইশরাত রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।

এটা শুধু ইশরাতের সমস্যা নয়। এদেশে অনেক শিশু-কিশোর এরকম সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, আমাদের দেশে অনেক শিশু অপুষ্টির জন্য রক্তস্বল্পতায় ভোগে। কারও কারও এ সমস্যা এত বেশি হয় যে, তাদের মাঝে মধ্যে রক্ত দিতে হয় বা ওষুধ খেতে হয়। এজন্য কিশোর বয়সে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার প্রয়োজন। নইলে রক্তস্বল্পতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বেশি অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স ১০-১৯ (বিবিএস প্রজেকশন, অপ্রকাশিত)। বাংলাদেশ জনতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০১৪ অনুযায়ী, শহর ও গ্রামের ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীর পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা আশঙ্কাজনক, বিশেষ করে কিশোরীদের খর্বাকৃতি হার শহর ও গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে ৩৯.৯ এবং ৩৪.৫% এবং রক্তস্বল্পতার হার ৪০% এবং ৩৬%। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অপুষ্টির তীব্রতা বিবেচনা করে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যের জন্য সরকার জাতীয় কৌশল ২০১৭-৩০ এবং পুষ্টির জন্য দ্বিতীয় জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে উৎপাদনশীল কর্মী বাড়বে এবং অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমবে। বলা হচ্ছে, কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ ধরনের কার্যক্রম তাদের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে এবং বিদ্যমান অপুষ্টির দুষ্টচক্রকে প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে।

২০২০-এর অক্টোবরে ‘কৈশোরকালীন পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়নে গাইডলাইন ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় পুষ্টিসেবা, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (মাওশি) অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এবং ইউনিসেফের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় গাইডলাইনটি প্রণয়ন করা হয়। পুষ্টিবিষয়ক এই গাইডলাইনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা এবং কমিউনিটি ক্লাবগুলোতে অনুসরণ করা হবে।

ইউনিসেফের পুষ্টিবিষয়ক কর্মকর্তা ডা. আইরিন আখতার চৌধুরী বলেন, “১০-১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকে, বিশেষ করে পুষ্টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করছি। কিশোর-কিশোরীদের কাছে সহজে পুষ্টি সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য আমরা দুই ধরনের শিশুদের জন্য এটা করেছি। যারা স্কুলে যায় এবং যারা স্কুলে যায় না তাদের জন্য। যারা স্কুলে যায় না, সেসব কিশোর-কিশোরীদের জন্য আমরা কমিউনিটিভিত্তিক কাজ করছি। কৈশোরকালীন পুষ্টিকে সবদিক দিয়ে পরিপূরক করার জন্য ছয়টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ১. তাদের পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানদান, ২. সাপ্তাহিক আয়রণ ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট সরবরাহ, ৩. বছরে দুবার কৃমিনাশক ওষুধ সরবরাহ, ৪. বছরে দুবার ওজন-উচ্চতা মেপে দেখা হবে তাদের বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ঠিক আছে কিনা। যদি ঠিক না থাকে বা কারও ওজন বেশি হলে তাকে সে বিষয়ে গাইডলাইন দেয়া হবে, যা সে মেনে চললে তার ওজন-উচ্চতা ঠিক থাকবে। ৫. তাদের নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে এবং ৬. ‘রেফারাল হেলথ’-এর আওতায় মানসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে ভোগা কিশোর-কিশোরিদের প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।”

কিশোর-কিশোরীদের কীভাবে বিষয়গুলো জানানো হবে জানতে চাইলে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. মাযহারুল হক মাসুদ বলেন, “এজন্য প্রত্যেক স্কুলে কিশোর-কিশোরীদের একটি ক্লাব গঠন করতে হবে। ক্লাবের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ক্লাবটি তাদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করবে। একটি ক্লাবে ৩০ জন সদস্য থাকবে এবং একজন নারী এবং একজন পুরুষ শিক্ষক গাইড হিসেবে থাকবেন। এতে প্রত্যেক ক্লাসের ছয়জন শিক্ষার্থী থাকবে। ক্লাবে একেক দিন একেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। প্রত্যেক ক্লাসের প্রতিনিধি হিসেবে যারা থাকবে, তারা সেই আলোচনা শুনে তাদের ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তা আলোচনা করবে। এভাবে কিশোর-কিশোরীরা তাদের নিজের নিজের জীবন থেকে শিখবে। যখন তারা বড় হবে এবং তাদের পরিবার হবে তখন তারা পরিবারকে এবং সন্তানদেরও বিষয়গুলো জানাতে পারবে। যদি এটা সফলভাবে করা যায়, তাহলে আগামী প্রজন্ম যেমন সারাজীবন ধরে এর সুফল পাবে, তেমনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিষয়গুলো জানবে এবং মেনে চলবে। এতে আমরা একটি সুগঠিত এবং স্বাস্থ্যবান জাতি পাব।”

এতে স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমবে। বাল্যবিবাহের হার কমবে। শিশুমৃত্যুর হার কমবে। কিশোরী বয়সে গর্ভধারণবিষয়ক জটিলতা কমবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। অপুষ্টিজনিত রোগ-ব্যাধি, ওজন বৃদ্ধি কিংবা অন্যান্য সমস্যাগুলোও কমে যাবে।

গাইডলাইন অনুসারে স্কুলগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়গুলো কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়টি খেয়াল রেখে ইউনিসেফ একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কভিডের কারণে স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় প্রশিক্ষণটি তারা অনলাইনে একটি অ্যাপসের মাধ্যমে চালু করেছে। গুগল প্লে স্টোরে ‘অ্যাডোলেসেন্ট নিউট্রিশন অ্যাপস’ নামে একটি অ্যাপস রয়েছে। এটা ব্যবহার করে যে কেউ এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। তিন ঘণ্টা সময়ব্যাপী প্রশিক্ষণটি এমন যে, একটা ধাপ শেষ না করে আরেকটা ধাপে যাওয়া যায় না। প্রশিক্ষণটি এভাবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয় এবং প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীকে অনলাইনেই একটি সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া হয়। আইরিন জানান, ইতোমধ্যে অ্যাপসটি ব্যবহার করে শতকরা ৮০ ভাগ কর্মকর্তা (এ বিষয়ে যারা কাজ করবেন), প্রশিক্ষণটি নিয়েছেন। যদিও করোনার কারণে বর্তমানে স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় প্রশিক্ষণটি পরিচালিত হচ্ছে না, তবুও এর সাফল্য নিয়ে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষণটি কিশোর-কিশোরীসহ সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও তারা ভাবছেন। এটা কতটা প্রয়োজনীয় এবং এতে শিক্ষার্থীরা কতটা উপকৃত হবেÑজানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘কিশোর বয়সে পুষ্টিকর খাবারের অভাব হলে তাদের মনোযোগ কমে যায়, মেধার বিকাশ ঠিকমতো হয় না, তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং শরীরে নানারকম সমস্যার জন্য তাদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে প্রত্যেকের সচেতন থাকা দরকার। আমরা কিছুদিন বিভিন্ন স্কুলে শিশুদের পুষ্টিবিষয়ক কার্যক্রম ‘মিড ডে মিল’ নামে একটা কর্মসূচি করেছিলাম। এটার ইতিবাচক দিকটি আমাদের জানা ছিল। তাই যখন কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিবিষয়ক কার্যক্রমটির বিষয়ে জানলাম তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এটা খুব ভালো কাজ হবে। স্কুলে যদি শিক্ষার্থীরা পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে এবং সেটা ঠিকভাবে গ্রহণ করে, তাহলে তাদের জন্য অনেক উপকার হবে। এজন্য অভিভাবক এবং শিক্ষকদের এক হয়ে কাজ করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভুল খাবার এবং অপরিষ্কার খাবার খাওয়ার যে কালচার রয়েছে, সেটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমরা খাব কিন্তু তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যেভাবে খাওয়া নিয়ম সেভাবে খাব। তাহলে শরীর এবং মনের জন্য তা যথাযথভাবে কাজ করবে। তারা সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার পেলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের অন্যান্য দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।’

পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা এবং গুণাগুণ সম্পর্কে আরও জানা যায়, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের লাইন ডিরেক্টর (জাতীয় পুষ্টিসেবা) ডা. এসএম মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘কিশোর বয়সে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ সময় তারা যথেষ্ট খেলাধুলা করে, খাবারের প্রতি তাদের চাহিদা থাকে, অনেক সময় তারা ভুলভাল খাবার খেয়ে ওজন বৃদ্ধি করে, এ সময় তাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়ে এবং মনোজগতেও নানা পরিবর্তন হয়। এমনকি এ সময় তাদের জীবনবোধও গড়ে ওঠে এ রকম আরও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এ সময়টা পার করে। এ সময়ই তাদের পুষ্টিকর খাবার বেশি প্রয়োজন। এতে তাদের শরীর ও মন যেমন গঠিত হতে সাহায্য করবে, তেমনি তাদের মেধার বিকাশেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। আর এ সময় যদি তারা নিজেরা জানতে পারে কোন খাবার তাদের কীভাবে খেতে হবে, তাহলে তারা সেটা ভালোভাবে ফলো করবে। পুষ্টিকর খাবার মানে দামি খাবার নয়। আমরা বলছি, প্রত্যেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাবে। তাদের মা-বাবার আয়ের ওপর তা নির্ভর করবে। তবে মনে রাখতে হবে, তাদের আয়ত্তের মধ্যে বেস্ট জিনিসটি খেতে হবে। বিষয়গুলো আমরা কমবেশি সবাই জানি। শুধু সঠিকভাবে বিষয়টি আমরা তাদের ধরিয়ে দিতে চাই।’

যে রকম উদ্দেশ্য নিয়ে কৈশোরকালীন পুষ্টির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, সেটা একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং খুবই কার্যকর পদ্ধতি এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা বাস্তবায়িত হলে দেশের শিশু-কিশোরদের অপুষ্টিজনিত যেসব রোগ-ব্যাধি আছে, তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটা শুধু প্রশিক্ষণ বা আলোচনার বিষয় নয়, এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিভাবক সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তবেই সম্ভব কাক্সিক্ষত ফলাফল প্রাপ্তি এমনই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবার।

পিআইডি নিবন্ধন