কৈশোরে মা-বাবার সঙ্গে হঠাৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়। হঠাৎ তা মিটেও যায়। দেখা যায় দু’পক্ষই মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আবার এক হয়ে একে অপরের ভুল সংশোধনের চেষ্টা করে। একে অন্যের সম্ভ্রম আদায় করে।
বোঝাই যায়, এ সময় উভয় পক্ষের আন্তঃসম্পর্ক সহযোগিতা, সহমর্মিতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
বাবা-মায়ের উচিত পরিণত ও আবেগপূর্ণ আচার-আচরণ করা। সাধারণত তারা কিশোর কিংবা কিশোরীটির সম্পর্কে একটি পূর্ব ধারণা তৈরি করে নেন এবং যখনই তারা ধারণার সঙ্গে সন্তানের
আচার-আচরণটি মেলাতে পারেন না, তখনই তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। এ বিষয়ে তাদের সচেতন হতে হবে। নতুবা সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের সময় এ তর্কযুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এ দ্বন্দ্ব বা সংঘাতগুলো শুরু হয় পড়াশোনা না করা, বাইরে ঘোরা, টিভি দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে অতিরিক্ত সময় কাটানো, পোশাক, মূল্যবোধ, প্রেম, নেশা করা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে।
আন্তঃসম্পর্ক যেন তেতো না হয়, সেজন্য মা-বাবাকেই সতর্ক থাকতে হবে। মেজাজ হারালে চলবে না। তাহলে কিশোর-কিশোরীরা তাদের সঠিক আত্মপরিচয় আবিষ্কার করবে। তারা কুশলী হয়ে উঠবে। যুক্তি-বুদ্ধি ও বিচারবোধে পারদর্শী হয়ে উঠবে। নিজের অহং পরিহার করে আত্মপরিচয়ে বিকশিত হবে।
বড়দের উচিত ছোটদের এ সময়ের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো মেনে নেওয়া। এর ওপরই নির্ভর করবে বড়দের সঙ্গে ছোটদের সম্পর্ক। অনেক সময় এ পরিবর্তনগুলো মেনে নেওয়া যায় না। এতে উদ্বিগ্ন অবস্থা, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, রাগ, দুঃখ, অভিমান প্রভৃতি সৃষ্টি হতে পারে। বাবা-মা ও কিশোরদের মধ্যে টেনশন তৈরি হতে পারে। এজন্য কিশোর-কিশোরীদের কাছে বাবা-মায়ের আকাক্সক্ষার পরিমাণ কমাতে হবে। কর্তৃত্বপরায়ণ হলে চলবে না। সন্তানকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করা যাবে না।
বড়রা কিশোরদের থেকে প্রত্যাশা করেন, তারা সুবোধ বালকের মতো একদিকে ন্যায়পরায়ণ ও কর্তব্যপরায়ণ হবে; অন্য দিকে ঝকঝকে স্মার্ট হবে। একদিকে সে পড়াশোনায় তুখোড় হবে, অন্যদিকে সে বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে বা মেয়ে হবে। ফলে অবধারিতভাবে অতি তুচ্ছ কারণেও তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়। অনেক সময় ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে অহেতুক ভয় পেতে শুরু করে; ফলে তাদের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। ছেলেমেয়েরা তাদের চিন্তা-ভাবনা ক্রমশ গোপন করতে শুরু করে। ফলে বহু প্রয়োজনীয় পরামর্শ থেকে তারা বঞ্চিত হয়।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন মজবুত হলে নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ থাকলে কিংবা একে অপরের সঙ্গে সুন্দর বোঝাপড়ার সুযোগ থাকলে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না। আবেগ-ভালোবাসা, শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা, গ্রহণ-বর্জন, মতৈক্য-মতানৈক্য প্রভৃতি বিষয় মিলিয়ে সমাধানের রাস্তায় হাঁটতে হবে। তাহলেই কিশোর-কিশোরীরা তাদের মনের সব ভাবনা মা-বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবে। ফলে সব সময় স্বস্তিবোধ করবে দু’পক্ষ।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে একজন মানুষের জীবনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারের জীবন ধারণ কিংবা জীবনচর্চার প্রভাব তার মধ্যে পড়তে বাধ্য। কিশোর-কিশোরীর ব্যক্তিত্ব গঠনে অভিভাবকদের তাই দায়িত্ববান হতে হবে। কেননা, সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর এর প্রভাব হবে সর্বাধিক ও দীর্ঘস্থায়ী।
মানুষ যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি প্রতিটি পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ও জীবনচর্চা ভিন্ন ধরনের।
কিশোর-কিশোরীদের কোন কাজে উৎসাহিত করবে এবং কোন কাজে বাধা দেবে এ ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সাধারণত একটি পরিবারের চাওয়া থাকে তাদের সন্তান স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। কখনও হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ করবে না। তাদের আচরণে যেন বাড়ি বা পরিবারের মর্যাদা যেন ক্ষুন্ন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। এ বয়সেই যেন ছোটদের ভবিষ্যতের ভিত গড়ে ওঠে, সে চেষ্টা করেন বড়রা। এসব দিক বিবেচনায় পরিবার তাকে বা তাদের তৈরি করে।
পরিবারের উচিত শিশুদের প্রতিযোগিতার মনোভাব পরিহার করে জীবন গঠনে উৎসাহ দেওয়া। তারা যেন কর্তৃত্বপরায়ণ না হয়। সহযোগিতার মনোভাব থাকবে তাদের মধ্যে। সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলাধুলা করে বড় হবে। আরও বড় বিষয়, নিজেদের ক্ষতি করে বাইরের কোনো কাজ করবে না এবং নিজেদের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবে না। এসব বিষয়ে সম্যক ধারণা দেবে পরিবার। ছোটদের ওপর যেন পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
ঘর ও বাইরের কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার সময় এই কৈশোর। ঘর-গৃহস্থালির কাজই যে একমাত্র কাজ সেটা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে।
পরিবারগুলো যেন বাচ্চাদের বড় করার মজবুত আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে পরিবারের বড়দের।