মাহমুদুল হাসান সুমন: একটি রাষ্ট্রের বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর অংশকে মূলধারার অংশে অন্তর্ভুক্ত করতে চাকরি, পড়াশোনা বা অন্যক্ষেত্রে তাদের জন্য যে নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ রাখা হয় তা-ই কোটা। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে ২৯(১) যেখানে উল্লেখ আছে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভে ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকবে এবং ২৯(৩)ক বলা হয়েছে নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত। প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে এজন্য তাদের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা বা কোটা রাখা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদসমূহে চাকরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে সব নাগরিকের সমান সুযোগের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছিল। তাহলে সরকারি নিয়োগ যে কোটায় হয় তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রথমত, কোটার বড় অংশ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের নাতি-পুতিদের জন্য বরাদ্দ রেখে সারাদেশের ছাত্রদের বঞ্চিত করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই-আড়াই লাখ, অর্থাৎ এক হাজার মানুষের মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ দশমিক ২ জন বা ১ দশমিক ৫ জন। যা সমগ্র জনসংখ্যার ০.১২/০.১৫ শতাংশ। ০.১২ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। যা হাজারে রূপান্তর করলে দেখা যায়, এক হাজার জনতার মাঝে ১ থেকে ১.৫ (দেড়) জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০০। এর মতো বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে!
এ বৈষম্য থেকে মুক্তি জন্য আগেও কয়েকবার আন্দোলন হলেও তা দানা বাঁধতে পারেনি কিন্তু কোটা আন্দোলন প্রথমবারের মতো বড় আকারে ছড়ায় ২০১৮ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল এবং এর পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ও দুই সাংবাদিক।
এতে কোটা পদ্ধতিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মার্চ মাসে এসে ওই রিটটি খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে আদালতে রিট করার পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘কোটা সংস্কার চাই’ নামে একটি পেইজ খোলা হয় এবং শাহবাগে তারা মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া শুরু হয়। এর মাধ্যমেই মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ সময় কোটা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গঠন করা হয়। রিট খারিজ হওয়ার পর কোটা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন করা হবে না মর্মে আদেশ জারি করা হয়।
শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া আন্দোলন চালিয়ে যান। তাদের দাবি ছিল পাঁচটি। এগুলো হলোÑ
১. সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা; ২. কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকা থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া; ৩. সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ; ৪. কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা; ৫. চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা। আন্দোলন দমন করতে টিয়ারগ্যাস ও ফাঁকা গুলি চালায় এবং কয়েকজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলে এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সারাদেশেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলন কর্মসূচির মুখে ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় আরো পরে- অক্টোবর মাসে। এতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৪তম থেকে ২০তম অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকেই নিয়োগের কথাও জানানো হয়।
এরপর কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। গত ৫ জুন ২০২৪ তারিখে তাদের পক্ষে রায় আসে, অর্থাৎ আগের মতো কোটা বহাল হবে বলে জানান আদালত। এদিকে হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। সেই আবেদন গত ৪ জুলাই শুনানির জন্য এলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। এরই মধ্যে ১ জুলাই থেকে কোটা বাতিলে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে’ এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলন দমাতে সারাদেশে অতর্কিত হামলা চালায় যার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধমের তথ্য অনুযায়ী ২৭ জুলাই পর্যন্ত ২০৯ জনের মৃত্যু এবং ৫৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির খবর প্রকাশ করেছে যাতে ১৬ জুলাই ৬ জন, ১৮ জুলাই ৪২ জন, ১৯ জুলাই ৮৫ জন, ২০ জুলাই ৩৮ জন, ২১ জুলাই দুজন, ২২ জুলাই ৫ জন, ২৩ জুলাই ৩ জন, ২৪ জুলাই ৩ জন, ২৫ জুলাই ৫ জন, ২৬ জুলাই ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। উল্লেখ্য, গত সোমবার থেকে সব মৃত্যু চিকিৎসাধীন অবস্থায় হয়েছে।
সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে কেন গুলি চালানো হলো? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? ১ জুলাই ছাত্ররা যখন আন্দোলনে নামে সেদিনই উচিত ছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমাধান খুঁজে বের করা। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলনে কোনো কর্ণপাত করেনি সরকার। ধীরে ধীরে আন্দোলনের পরিসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার সতর্ক হয় এবং সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মোতায়েন করে। দেশের যেখানেই আন্দোলন হয়েছে, সেখানেই পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়েছে। ১৬ জুলাই থেকে মৃত্যুর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে মৃত্যুর সংখ্যা দীর্ঘ হতে থাকে। এ অবস্থায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আন্দোলন নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে তিন সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনায় বসেন আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর কাছে আটটি দাবি জানান। পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আট দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- নিহতদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে গ্রেপ্তার ও বিচার। শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও তাদের পিতা-মাতার মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্যকে চাকরির নিশ্চিয়তা দেওয়া। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা এবং ছাত্র সংসদ চালু করা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দেওয়া। আট দফা দাবির ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফলে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এর মধ্যে সরকার ১৮ জুলাই রাতে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে অনলাইন ক্র্যাক ডাউন সৃষ্টি করে জনগণকে অনলাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং দেশে কারফিউ জারি করে এ পরিস্থিতি সামাল দেয় সরকার।
আপিল বিভাগের পূর্বনির্ধারিত তারিখে আপিল বিভাগ কোটা যৌক্তিক সংস্কারের রায় দেন। রায়ে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সব গ্রেডে ৯৩ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ উল্লেখ করে রায় দেয় এবং সরকার গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে। রায় এবং প্রজ্ঞাপনে ছাত্রদের বিজয় হয়েছে বলে মনে করি।
রায় ও প্রজ্ঞাপন জারির পর পত্রিকার তথ্যমতে, চার দফা ‘জরুরি দাবি’ জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। চার দফা পূরণ হলেই তাদের মূল আট দফা দাবি নিয়ে আলোচনার পথ তৈরি হবে বলে মনে করছেন তারা। কিন্তু সরকার চার দফা না মানলে আট দফা দাবি নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমাপ্তি বা প্রজ্ঞাপন বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিয়ে তাদের আন্দোলন যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানে সমাপ্ত ঘোষণা করার সুযোগ দিন।