নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গতকাল বুধবার ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সোয়া ১১টায় শিক্ষার্থীদের একটি দল রাজধানীর শাহবাগ মোড়ের সড়ক অবরোধ করেন।
এছাড়া পল্টন মোড়, জিরো পয়েন্ট, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টাল, বাংলামোটর, ফার্মগেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এতে সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভোগান্তিতে পড়েন জনসাধারণ। রাজধানীর বাইরেও সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেলপথে অবস্থান নেয়ার কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গতকাল সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারীরা। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা মঞ্চ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। তাদের উদ্যোগে শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় সড়ক অবরোধ করা হয়। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানে দুপুর থেকে অবস্থান নেয়া চাকরিপ্রত্যাশী কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিকাল ৪টায় সড়ক অবরোধে যোগ দেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার অষ্টম দিনের মতো এই কর্মসূচি পালন করেন তারা। তারা চান ‘বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করা হোক।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে রেল অবরোধের পর এবার সড়কও অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস মোড় অবরোধের মধ্যে দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। এর ফলে নগরের ব্যস্ততম সড়ক টাইগারপাস দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে রেল অবরোধ করেন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা। এর ফলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, কক্সবাজারের ট্রেন আটকে পড়ে।কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টায় গাছের গুঁড়ি ফেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে অবরোধ শুরু করেন। একই স্থানে মানববন্ধনও করেন তারা।
কোটা বাতিলের দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ৩০০ থেকে ৪০০ শিক্ষার্থী জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়িতে মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে মহাসড়কের দুপাশে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পদুয়ার বাজার পর্যন্ত অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। বেলা সাড়ে ৩টায় শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে যান।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ৩টায় ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। অন্যদিকে চতুর্থ দিনের মতো রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বুধবার সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ থেকে আবদুল জব্বার মোড় পর্যন্ত তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন। বেলা ১১টায় আবদুল জব্বার মোড়সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করে ঢাকা থেকে আসা দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ৪টা পর্যন্ত ট্রেনটি আটকে ছিল।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের এক দফা দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে যোগ দেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও। এতে সড়কটির দুপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে এ কর্মসূচি পালন করছেন তারা। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের প্রায় ৩২ জেলার মানুষের স্থলপথে যোগাযোগের একমাত্র মহাসড়ক এটি। এতে সড়কের দুপাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা-বরিশাল ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একযোগে এই মহাসড়কের দুই অংশে অবস্থান নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে তারা টায়ার জ্বালিয়ে ও আগুন ধরিয়ে মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। মেঘ, রোদ ও বৃষ্টির মধ্যেও তারা মহাসড়কে বসে দাবির পক্ষ সেøাগান দিতে থাকেন। এতে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বরিশাল থেকে দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলার সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের দুই প্রান্তে অসংখ্য যাত্রী ও পণ্যবাহী যান আটকে পড়ে।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে রংপুরের মডার্ন মোড়ে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টাব্যাপী চলে এই অবরোধ কর্মসূচি। অবরোধের কারণে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। উত্তরের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, রংপুরসহ ছয় জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ দক্ষিণের জেলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে রংপুরের ওপর দিয়ে দূরপাল্লার বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগে এ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাবি শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে দেশের আনাচে-কানাচে বাংলা ব্লকেড অব্যাহত রাখবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় ব্লকেড পালিত হবে।
প্রসঙ্গত, গতকাল আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটা বহালে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন।