Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:02 pm

কোটি করদাতার হাতছানি

রহমত রহমান: দেশে প্রতিনিয়ত করযোগ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। কিন্তু জনবলের অভাব, অটোমেশন আর প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় করনেট সম্প্রসারিত হচ্ছে না। দেশের কয়েকটি খাত থেকে অন্তত তিন কোটি করদাতাকে করনেটে আনা সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল গাড়িসহ ব্যক্তিগত গাড়ি মালিক, যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান, আবাসন (জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট), বাড়ি মালিক, ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী।

পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য, সঞ্চয়পত্র মালিক, ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী, অভিজাত ক্লাব সদস্য, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, কমিউনিটি হল, ক্লাবে অনুষ্ঠানের ভাড়া গ্রহণকারী এবং বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ব্যবহারকারী।

এছাড়া আছেন বিদেশে ভ্রমণকারী ও দেশে কাজ করা বিদেশি প্রকর্মী। এসব খাত থেকে তথ্য সংগ্রহ ও জরিপের মাধ্যমে করনেট সম্প্রসারণ করতে চায় কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল, ঢাকা। এ নিয়ে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে এনবিআরের কাছে প্রয়োজনীয় জনবল, অটোমেশন ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ চায় এ কর অঞ্চল।

কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল সূত্রমতে, দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের আয়ও বাড়ছে। ফলে বাড়ছে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ার ইত্যাদি। এছাড়া বিলাসবহুল বাস ও প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে, কিন্তু এসব গাড়ির মালিক করের আওতায় আসছে না।

এমনকি অনেক শিল্প উদ্যোক্তা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের একাধিক গাড়ি থাকলেও আয়কর ফাইলে তা দেখানো হয় না। গাড়ি মালিকদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল। দেশ থেকে গাড়ি কেনা হোক বা আমদানি করা হোক, রেজিস্ট্রেশন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, সড়কে চলাচলকারী বিলাসবহুল গাড়ি মালিকরা সঠিকভাবে কর প্রদান করেন কি না, তা যাচাই শুরু করে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল। সম্প্রতি বিআরটিএ থেকে এক হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৮৯১টি গাড়ির ই-টিআইএন যাচাইয়ে দেখা যায়, ১২৬টি গাড়ির নিবন্ধনে জাল ই-টিআইএন ব্যবহার করা হয়েছে। গাড়িগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বিএমডব্লিউ। এছাড়া রয়েছে ওডিআই ও জাগুয়ার। এসব গাড়ির মালিক করের আওতায় নেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনবিআর ও বিআরটিএ’কে চিঠি দেয়া হয়েছে। ই-টিআইএন ও আয়কর ফাইল নেই, এমন করদাতাদের মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা চেয়েছে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল।

অপরদিকে দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লাখ ৬৯ হাজার। সব গাড়ি মালিকের ই-টিআইএন যাচাই করা হলে ই-টিআইএনধারী ও করদাতার সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেজন্য বিআরটিএ’র সঙ্গে এনবিআরের অনলাইন কানেক্টিভিটি বাড়াতে কাজ করছে জরিপ অঞ্চল। বর্তমানে মনিটরিং বৃদ্ধি করায় গাড়ি নিবন্ধন থেকে করের পরিমাণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএর) হিসাবে, সারা দেশে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। নৌযানের মধ্যে রয়েছেÑলঞ্চ, ট্রলার, রকেট  স্টিমার), সি-ট্রাক, উপকূলীয় জাহাজ, ওয়াটারবাস ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এর মধ্যে প্রতিবছর আট হাজারের মতো ফিটনেট পরীক্ষা করা হয়। বাকিগুলো ফিটনেস ও রুট-পারমিট ছাড়াই চলাচল করে। নৌসড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির হিসাবে এ সংখ্যা ৬০ হাজার। তবে এ সংখ্যা লাখের বেশি।

এছাড়া রয়েছে কয়েক হাজার লাইটার জাহাজ, অয়েল ট্যাংকার ও বাল্ক হেড। নদীপথের এসব জনযানের বেশিরভাগ মালিক নেই করের আওতায়। বিআইডব্লিউটিএ-সহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এসব মালিকের তথ্য চায় কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল। জরিপের মাধ্যমে তালিকা করে এসব নৌযান মালিকের ই-টিআইএন ও রিটার্নের আওতায় আনা সম্ভব।

সূত্র জানায়, দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও প্লট ক্রয়-বিক্রয় হয়। বর্তমানে জমি, ফ্ল্যাট ও প্লট ক্রয়-বিক্রয়ে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক। এর পরও অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার করে। তবে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে বেশিরভাগের করযোগ্য আয় রয়েছে। ভূমি অফিস থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার তথ্য নিয়ে যাচাই করলে কয়েক লাখ ই-টিআইএন ও করদাতার সংখ্যা বাড়বে। সেজন্য কাজ করছে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল। তবে এনবিআর সহযোগিতা করলে তা সম্ভব।

অপরদিকে দেশে বর্তমানে আবাসন সম্ভাবনাময় একটি খাত। ঢাকাসহ দেশের সব শহর এমনকি গ্রামেও এটি বিস্তার লাভ করছে। বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি কেনাবেচা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ করদাতা করনেটে আনা সম্ভব। জরিপ অঞ্চল থেকে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের ক্রেতা-বিক্রেতার তথ্য যাচাই করে করনেটে আনা যায়। এ নিয়ে রিহ্যাবকে চিঠি দিয়েছে জরিপ অঞ্চল। অবশ্য সাড়া দেয়নি রিহ্যাব। এনবিআর সহযোগিতা করলে এ খাত থেকে কয়েক লাখ করদাতা করনেটে আনা সম্ভব।

সূত্রমতে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে নকশা অনুমোদন করে নিতে হয়। একইভাবে সারা দেশে বাড়ি বা ভবনের নকশা অনুমোদন করে নিতে হয়। নকশা অনুমোদনের সময় ই-টিআইএন যাচাই ও তাদের করের আওতায় আনা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চায় জরিপ অঞ্চল। রাজউকসহ এসব অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনলাইন কানেক্টিভিটি করা গেলে অনেক করদাতা করনেটের বাইরে চলে আসবে। ঢাকাসহ দেশের সব শহরে বহু বাড়ি মালিকের ই-টিআইএন নেই, নেই আয়কর ফাইল।

এসব বাড়ি মালিকের রয়েছে হোল্ডিং নম্বর, দিতে হয় হোল্ডিং ট্যাক্স। এসব বাড়ি মালিককে করের আওতায় আনার সহজ উপায় হলো হোল্ডিং নাম্বার। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা থেকে তথ্য নিয়ে এসব মালিককে করের আওতায় আনা সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চায় জরিপ অঞ্চল, সেজন্য এনবিআরের সহযোগিতা প্রয়োজন। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি সভা করা হয়েছে। সারা দেশের ট্রেড লাইসেন্সের তথ্য সংগ্রহ করে সেখান থেকেও করদাতা নেটে আনতে চায় জরিপ অঞ্চল।

অপরদিকে পেশাজীবী সংগঠন, সঞ্চয়পত্র মালিক, ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী, অভিজাত ক্লাব সদস্য, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, কমিউনিটি হল ও ক্লাবে অনুষ্ঠানের ভাড়া গ্রহণকারীদের তথ্য সংগ্রহ করতে চায় জরিপ অঞ্চল। এছাড়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ থেকে বিদেশে ভ্রমণকারী, বিডা থেকে বিদেশি প্রকর্মী ও বিদ্যুৎসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করতে চায় জরিপ অঞ্চল। এতে কয়েক লাখ নয়, অন্তত দুই কোটি করদাতা করনেটে চলে আসবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলকে দায়িত্ব দিতে এনবিআরকে একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল, ঢাকার সূত্রমতে, ঢাকাসহ চারটি বিভাগীয় শহরে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের অফিস রয়েছে। এ কর অঞ্চলে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ২০৮। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছে ১৪২ জন। শূন্যপদের সংখ্যা ৬৬। শূন্যপদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সাত, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৬, তৃতীয় শ্রেণির ১২ ও চতুর্থ শ্রেণির একটি পদ খালি রয়েছে। জনবল, প্রযুক্তি ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় ‘জরিপ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল। বিভাগীয় শহরে অফিস রয়েছে নামমাত্র। সেখানে অন্য কর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল, ঢাকার কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, করনেট বাড়াতে আমরা বেশ কিছু কাজে হাত দিয়েছি। এনবিআর আমাদের প্রয়োজনীয় অটোমেশন, কানেক্টিভিটি, জনবল ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিলে শুধু কোটি নয়, কয়েক কোটি করদাতাকে করনেটে আনা সম্ভব।

আরো পড়ুন-

বিলাসবহুল ৮৯২ গাড়ি মালিকের কর ফাঁকি খুঁজছে এনবিআর [1]

বিলাসবহুল ১২৬ গাড়ি মালিকে খুঁজছে এনবিআর-জাল টিআইএন [2]