গতকাল সারা বিশ্বে একদিনে চার হাজার মানুষের মৃত্যু আমাদের গভীর ভাবনায় ফেলেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছে কেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা আতঙ্কিত হবো না? আতঙ্কিত হলে যে সমস্যাটা প্রথম তৈরি হবে তা হলো করোনা আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র মানুষজন দিগ্বিদিক (যদিও এর সরাসরি কোন চিকিৎসা নেই) হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করবে। এতে অন্য সাধারণ রোগীরা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে করোনায় আক্রান্ত প্রায় ৮২% লোক বিশেষ চিকিৎসা ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেরে উঠে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে যদি আগেভাগেই মনে মনে মারা যাই, তবে যে ১৮% লোকের হসপিটালাইজড প্রয়োজন এবং ৫% এর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। তখন আতঙ্কিতরা হাসপাতালের বেডগুলো দখল করে রাখবো (চাল, ডাল, তেল স্টক করার মতো)।
সব সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতাল মিলিয়ে দেশে মোট এক হাজার ১৬৯টি আইসিইউ বেড আছে। তাছাড়া প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সাধারন বেড রয়েছে ৮টির কিছু বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সংখ্যা ১২৩টি, চীনে ৪৩টি, ইতালিতে ৩২টি। আমাদের চেয়ে ৫.৫ গুণ হাসপাতালের বেড বেশি হওয়ার পরও চীনে বড় বড় হাসপাতাল তৈরি করতে হয়েছে। আমাদের চেয়েও ৪ গুণ বেশি হাসপাতালের বেড থাকার পরও ইতালিতে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। তাই আমাদের প্রাণপ্রিয় মা-বাবার কথা চিন্তা করে হলেও আতঙ্কিত হবো না। অর্থাৎ যদি ধরে নেই আমাদের ৬৫ উর্দ্ধ বয়সীদের অনেকেই আক্রান্ত হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে আমরা তরুণ, যুবক বা শিশুদের নিয়ে যদি আতঙ্কিত না হয়। তবে সুষম বন্টনের মাধ্যমে তারা কিছুটা চিকিৎসা সেবা ও আইসিইউ সাপোর্ট পাবে। কারন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তরুণ, যুবক বা শিশুরা প্রায় ৮০-৯৫% হাসপাতালের সাধারণ চিকিৎসা বা বাসায় থেকেই সু্স্থ হয়ে উঠে।
এতে আতঙ্কিত না হয়ে হাসপাতালের ডাক্তার বা হাসপাতালের উপর চাপ সৃষ্টি না করি তবে আমাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অনান্য মুরব্বী বা জটিল রোগে আক্রান্ত যারা তারা কিছুটা সুচিকিৎসা পাবে। বিশ্ব পরিসংখ্যান অনুসারে, করোনায় ৮০ বয়সের উর্দ্ধে মৃত্যু হয়েছে ১৪.৮%, ৭০-৭৯ বয়সী মারা গেছে ৮%, ৬০-৬৯ বয়সী ৩.৬% , ৫০-৫৯ বয়সী ১.৩%, ৪০-৪৯ বয়সী ০.৪%, ১০-৪০ বয়সী ০.২%। আর ১০ বছরের নিচে সারা পৃথিবীতে মাত্র একজন মারা যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। গত ২৩ মার্চ আপডেট অনুসারে করোনায় মৃত্যুহার বেড়ে এখন ৪% কিছু বেশি। অথচ কিছুদিন আগে সংক্রমিত ইবোলায় মৃত্যুহার ৫০%, মার্স ও সার্সে মৃত্যুহার ৩৫% সেগুলো কাটিয়ে টিকে আছি আমরা।
আরো কিছু তথ্য দিচ্ছি আপনাকে। করোনাভাইরাস পৃথিবীতে একেবারে নতুন হওয়ায় একে সনাক্তকরণ কিট সারা পৃথিবীতে অপ্রতুল। তাই চীন, আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সবার পরীক্ষা করলেও বর্তমানে ০-৪০ পর্যন্ত যাদের শারীরিক জটিলতা বা শ্বাসকষ্ট নেই এবং বিদেশ ফেরত বা বিদেশ ফেরত কন্টাক্ট না, তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করছে না। এর তিনটি লাভ। প্রথমত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, এই বয়সীরা আক্রান্ত হলেও ৮০-৯৫% স্বাভাবিক চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সু্স্থ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রও আক্রান্ত রোগী কম দেখাতে পারলো। তৃতীয়ত, বয়স্কদের অর্থাৎ যাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি তাদের পরীক্ষায় কিট ও চিকিৎসার সুযোগ বেশি পাওয়া যাবে। যাই হোক সব কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের তালিকাবদ্ধ করলে মৃত্যুহার হয়তো ১-২% হতো।
১১৫ দিনের কাছাকাছি সময়ে প্রায় ২০০টি দেশে ৭.৫ লাখের কাছাকাছি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫৯ হাজার পার করেছে। অথচ ধুমপানের কারণে একদিনে মারা যায় ১৭ হাজার ৫৩৪ জন। করোনায় ১১৫ দিনের মৃত্যু ধুমপানে দুইদিনের মৃত্যুর সমান দুইটি পরিসংখ্যানই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করেছে। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এক একটি জীবনের মূল্য কত? আমি বলবো পৃথিবীর সমান। কারণ যার যার জীবন তার কাছে পৃথিবীর চেয়েও মূল্যবান।
প্রতিটি মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমাদেরকে ডেথ ফোভিয়া নামক মানসিক অসুস্থতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আতঙ্ক আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে যা আমাদের এই মুহুর্তে খুব বেশি প্রয়োজন। করোনাভাইরাস যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাদের সাথে পেরে উঠে না। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে, কেন এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমি আতঙ্কিত নই? এক সহকর্মী জানাচ্ছিল, সারাদিন যেমনি কাটে বিকাল বা রাত হলে খবর শুনে বা ফেইসবুকে বিভিন্ন মানুষের আর্তনাদ আমাকে ভিতর থেকে ভেঙ্গে ফেলছে, মনে হয় শেষ হয়ে গেলাম। দুইমাস যাবৎ খালি জ্বর জ্বর মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি গলাব্যাথা শুরু হলো। সারাদিনে কয়েকশ বার ডুক গিলি দেখি গলাব্যাথা হলো কি না? গত কিছুদিন আগে ব্লিচিং জীবাণুনাশক তৈরি করতে গিয়ে ব্লিচিং এর ধাঁচে গলা ব্যাথা হয়। পরবর্তীতে সবার কাছে মাফ চাওয়া শুরু করি।
শুনলাম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত অনেকটা বসন্তের মতো অর্থাৎ জীবনে একবার হয়ে গেলে আর আক্রান্ত হবে না। তখন থেকে শুধু মনে মনে ভাবছি করোনা হইলে হয়ে যাক, প্রতিদিন কুড়ে কুড়ে মরার চেয়ে একবারে মরলেই ভালো। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আমাদের মৃত্যু ঝুঁকি খুবই কম, তারপরও না মনকে মানাতে পারি না। বুঝলাম সহকর্মী করোনা নিয়ে মারাত্মক আতঙ্কে আছে। মনোবিজ্ঞানীদেন মতে, আতঙ্কে থাকলে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
করোনাভাইরাস কমিউনিটি লেবেলে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাতে যে কেউ আক্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে আতঙ্কিত হলেই তৈরি হবে ঝামেলা। করোনাভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে, যা খুবই সূক্ষ্মভাবে আপনাকে আক্রান্ত করতে পারে। কিছুদিন আগে রয়টার্স নিউজ করলো ভাইরাসটি হাঁচি-কাঁশির সূক্ষ্ম ড্রপলেটের সাথে ৩ ঘণ্টা অবধি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমাকে বিভিন্ন হাসপাতালে বা বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় রিপোর্ট করতে যেতে হয়। তখন যদি আমি পিপিই (ব্যক্তিগত নিরাপদ সরঞ্জাম) পরিহিত না থাকি, তবে আমি সর্বোচ্চ সচেতন হলেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি।
শুরুতেই কেন আমরা আতঙ্কিত তার কিছু কারন একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। প্রথমত, প্রতিকারক অজানা থাকায় এই রোগে পৃথিবীর প্রতিদিনের মৃত্যুহার এবং বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, সেলেব্রিটি বা হেভিওয়েট ব্যক্তিদের আক্রান্ত হতে দেখে আমরা ভিতর থেকে ভেঙ্গে যাচ্ছি। কারন উন্নত দেশেই এই অবস্থা তাহলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কি অবস্থা হবে।
আমার উত্তর হবে, যেদিন চীনে একদিনে ২৫৪ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিশ্বব্যাপী দিনটিকে কালো দিন হিসেবে অবহিত করা হয়। অথচ দেখুন আজ যদি দেখি ইতালিতে ২৫৪ জন মারা গেছে তাহলে এটাই হবে পৃথিবীর আলোর দিন। কারন প্রতিদিন ৭০০-৮০০ মানুষের মৃত্যুর খবর শুনতে হচ্ছে। সংখ্যাটা কিছু কম শুনলে ভালো লাগে। কোভিড-১৯ মহামারীর পিক আওয়ার শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিন পর একদিনে ৫০ হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে হয়তোবা আঁতকে উঠবো না। তার মানে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি।
কারন পরিস্থিতি মেনে না নিয়ে আমাদের উপায় নেই। পৃথিবীর কেউ কি মৃত্যু থেকে নিজেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে? তাছাড়া হেভিওয়েট ব্যক্তিরা কি কখনো অসুস্থ হয় না? ইতালি, আমেরিকা ও ইউরোপে এই মৃত্যুহার আরো বাড়তে পারে। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত থাকার কারনে সেখানে ৬৫ উর্দ্ধো বয়সী বেশি। আর এই ভাইরাসটি ৬৫ উর্দ্ধো বয়সীদের জন্য মৃত্যুযম। ইতালিতে ৬৫ উর্দ্ধো বয়সী ২৩%, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬% আমাদের দেশে এই হার ৩% কাছাকাছি। তারমানে কি আমরা ৩% মানুষের মৃত্যু কামনা করছি? আমার প্রাণপ্রিয় মা এই বয়সী। আমরা আতঙ্কিত হলে ৬৫ উর্দ্ধো বয়সীদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিভাবে সর্বনাশ হবে তা নিচে ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
সর্বশেষ বলতে চাই, করোনাভাইরাস আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেছে বলে আমার মনে হয়। যার দরুন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সরকারের জাতীয় ঐক্যর আহবান এত বড় বিপদের মধ্যও খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছি। তাছাড়া এত বড় সংকটে মুক্তিযুদ্ধের মতো কনক্রিট ঐক্য ছাড়া পরিত্রাণ পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধে ঘরের বাহিরে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করেছিলাম। এবার আমরা ঘরে অবস্থান করে বা ঘরে থেকে দেশকে রক্ষা করবো ইনশাআল্লাহ।
নাজমুল হক
প্রভাষক ও কলামিস্ট
বনানী বিদ্যানিকেতন কলেজ
০১৬১১৫৬৫৪০৮
sumon.cdenim@gmail.com [1]