Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:25 am

কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগও পড়ছে ঝুঁকিতে

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: নব্বইয়ের দশক থেকে অতিথি আপ্যায়নে জনপ্রিয় কনডেন্সড মিল্কের চা। গণমাধ্যমে বেশি প্রচারিত হতো বিভিন্ন কনডেন্সড মিল্কের বিজ্ঞাপন। এ খাতের কোম্পানিগুলোর বিক্রি ও মুনাফা ছিল বেশ ভালো। কিন্তু এখন মানুষ আগের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসচেতন। ফলে পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসেও। এতে কয়েক বছরে কমেছে কোম্পানিগুলোর বিক্রি ও মুনাফা। অধিকাংশ কোম্পানির ক্রমাগত লোকসান ও বাজার সংকোচনে হুমকির মুখে পড়েছে এ খাতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।

জানা যায়, দেশে কনডেন্সড মিল্ক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম ও বড় কোম্পানি হলো পারটেক্স গ্রুপের ‘ড্যানিশ কনডেন্সড মিল্ক’। এ প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে। এ বৃহৎ কোম্পানিটি দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান ও ভারতের বেশ কয়েক অঞ্চলে রপ্তানি করত। এরপর চট্টগ্রামের এসএ গ্রুপের সামাননাজ কনডেন্সড মিল্ক লিমিটেড ব্যবসায় আসে। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডের নাম ‘গোয়ালিনী’। ১৯৯৫ সালে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় আট হাজার ৪০০ টন।

এছাড়া তাসনিম কনডেন্সড মিল্ক (নাম্বার ওয়ান), মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক (ফ্রেশ), সানোয়ারা কনডেন্সড মিল্ক (ডিপ্লোম্যাটিক) ও আবুল খায়ের কনডেন্সড মিল্ক (স্টারশিপ) বর্তমানে উৎপাদনে আছে। এসব কোম্পানি গড়ে মাসে সাত লাখ কার্টন কনডেন্সড মিল্ক বিক্রি করে। প্রতি কার্টন গড়ে দুই হাজার টাকা হলে মাসে ১৪০ কোটি টাকা। আর বছরে হয় প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ খাতে কয়েক বছর ধরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। গত চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রামের সানোয়ারা গ্রুপের সানোয়ারা কনডেন্সড মিল্ক লিমিটেডের ডিপ্লোম্যাটিক ব্র্যান্ডের কনডেন্সড মিল্ক। আর মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামালের শ্যালকের মালিকানাধীন মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক প্রায় দুই মাস আগে কারখানা বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রি ছিল পাঁচ কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয়, বিপণনসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহ করে নিট লোকসান দাঁড়ায় পাঁচ কোটি টাকা। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ১০৬ কোটি টাকা।

বিএসটিআই-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৭ সালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পাম ও সয়াবিন ফ্যাট কনডেন্সড মিল্কে ব্যবহারের বৈধতা দিয়ে নতুন মান নির্ধারণ করতে বিএসটিআইকে আদেশ দেয়। এরপর থেকে কমপক্ষে ছয়টি কোম্পানি তথাকথিত এসব কনডেন্সড মিল্ক তৈরি করছে। নতুন এ লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী, এসব কৌটা কনডেন্সড মিল্কের দাবি করতে পারবে না। এতে অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে মিষ্টি বা অমিষ্টি ‘কনডেন্সড ফিলড মিল্ক’, যাতে ২২ ভাগ গুঁড়োদুধ রয়েছে। কিন্তু এ কোম্পানিগুলো বড় বড় লাল অক্ষরে ‘মিষ্টি কনডেন্সড মিল্ক’ ও ছোট কালো অক্ষরে ‘ফিলড’ বা মিশ্রিত লিখেই বিপণন করছে তাদের পণ্য। সূত্র জানায়, এখনও পর্যন্ত বিএসটিআই অথবা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এসব দুধ পরীক্ষা করে দেখেনি যে, এসব প্রতিষ্ঠান খাদ্যযোগ্য উপাদান ব্যবহার করে তাদের পণ্য তৈরি করছে কি না।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলেন, আমদানি করা মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়োদুধ ও বিষাক্ত পাম স্টেরিন মিশিয়ে চিনি মিশ্রিত করে কনডেন্সড মিল্ক তৈরি করা হচ্ছে। যদিও লাইসেন্স অনুযায়ী, কনডেন্সড মিল্কে কমপক্ষে আট ভাগ মিল্ক ফ্যাট থাকতে হবে, যা গরু বা মহিষের দুধ থেকে তৈরি হতে হবে। কোম্পানিগুলো এই শর্ত অমান্য করে ভেজাল কনডেন্সড মিল্ক তৈরি করছে, যা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ  বিশেষত চা তৈরি করতে দোকান ও রেস্তোরাঁয় ব্যবহার করছে। ফলে সব বয়সের মানুষের দেহেই এ বিষাক্ত দুধ প্রবেশ করছে। বিষয়টি জানতে পেরে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ২০০৩ সালে ড্যানিশ কনডেন্সড মিল্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, আবুল খায়ের কনডেন্সড মিল্ক কোম্পানি, এসএ কনডেন্সড মিল্ক ও মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করে।

পরে কোম্পানিগুলো আদালতে একটি রিট পিটিশন করে, যা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলো সয়াবিন ও পাম ফ্যাট ব্যবহার করে কনডেন্সড মিল্ক তৈরি অব্যাহত রেখেছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কনডেন্সড মিল্কে ঘন চিনি ব্যবহার করা হয়, যা খুবই ক্ষতিকারক, স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে অন্ত্রের রোগ, কিডনি, লিভার, মূত্রথলির প্রেসার বাড়াতে পারে। এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত সৃষ্টি হতে পারে।’

ভেজাল কনডেন্সড মিল্ক বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান সৈয়দা সারোয়ার জাহান শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা কখনও কনডেন্সড মিল্কের খাদ্যমান নিয়ে পরীক্ষা করিনি। এ ধরনের অভিযোগও আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে কনডেন্সড মিল্কের মান পরীক্ষা করব। তখন ব্যবস্থা নিতে পারব।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পগ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, এ খাতে কোম্পানিগুলোর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। মূলত নেতিবাচক প্রচারের কারণে এ ব্যবসা সংকোচন হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর অসম প্রতিযোগিতার কারণে হুমকির মুখে পড়ছে বিনিয়োগ। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে তো কমছে ব্যবসাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু আছে। এটি মূলত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বানানো মিল্ক। এর বেশি কিছু বলতে আমি আগ্রহী নই।

এ বিষয়ে সানোয়ারা কনডেন্সড মিল্কের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মকবুল আহমেদ ফোরকান শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতি মাসে সাত লাখ কার্টন বিক্রি হয়। প্রতি কার্টন গড়ে দুই হাজার টাকা হলে মাসে ১৪০ কোটি টাকা। আর বছরের প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে এ খাতে গত কয়েক বছর ধরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এ কারণে অনেক কোম্পানি উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করছে। এ খাতে কেউ লোকসান করছে ব্র্যান্ড ভ্যালু ঠিকিয়ে রাখার জন্য, আবার কেউ করছে চিনি ও চা-পাতা বিক্রির জন্য। তিনি বলেন, কনডেন্সড মিল্কের ব্যবসায় এখন সবাই লোকসানে। অথচ এরই মধ্যে এ খাতের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের কনডেন্সড মিল্ক বন্ধ হয়ে গেছে দুই মাস আগে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ৪০০ গ্রামের একটি কনডেন্সড মিল্কের কৌটার দাম পড়বে ২০০ টাকা। আর সে জায়গায় দেশীয় বাজারের এক কৌটার দাম মাত্র ৪৮ টাকা! যা সম্ভব হয়েছে আমদানি করা মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়োদুধ, পাম স্টেরিন ও ক্ষতিকর চিনি মিশ্রণের কারণে।