কোম্পানির আয় বৃদ্ধির খবরে বিনিয়োগ আস্থা বেড়েছে

মো. আসাদুজ্জামান নূর: সমাপ্ত সপ্তাহে ইতিবাচক ধারায় লেনদেন হয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)।সাপ্তাহিক লেনদেনে বেড়েছে সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন। সপ্তাহজুড়ে শেয়ার কেনার পাশাপাশি বিক্রির প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে।

লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধির খবর ও অনেক কোম্পানির অপ্রকাশিত আয়ের সম্ভাবনায় বিনিয়োগকারীরা সরব ছিলেন সপ্তাহজুড়ে। প্রধান খাতগুলোয় লেনদেন ভালো হয়েছে। এতে সাপ্তাহিক লেনদেন বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ।

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলোচিত সময়ে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বেশির ভাগের আয় বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। কভিড-১৯-এর সংক্রমণ শঙ্কা কাটিয়ে যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুজ্জীবিত করেছে।

সার্বিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় লেনদেন হওয়া পুঁজিবাজারে গত দুই সপ্তাহ ধরে মুনাফা তোলায় ব্যস্ত ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির আয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পুনর্বিনিয়োগ করছেন তারা। বিদায়ী সপ্তাহেও যা পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে পোর্টফোলিও রিব্যালেন্সিংয়ের কারণে বেড়েছে বিনিয়োগ।

বিনিয়োগ বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে গত সপ্তাহের লেনদেনে। পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইতে মোট ছয় হাজার ৬১৭ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। যেখানে আগের সপ্তাহে লেনদেন ছিল ৬ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে এক হাজার ৩২৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যেখানে আগের সপ্তাহে গড় লেনদেন ছিল এক হাজার ২৮৫ কোটি টাকা।

সপ্তাহজুড়ে বিনিয়োগের বিষয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন বলেন, জানুয়ারি থেকে দর বৃদ্ধিতে থাকা শেয়ারে চলতি মাসে প্রফিট টেকিং হয়েছে। দর বৃদ্ধি হওয়া শেয়ারগুলো বিক্রি করে নতুন বিনিয়োগ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এটিই পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে পোর্টফোলিও রিব্যালেন্সিংয়ে কোম্পানিগুলোর প্রকাশিত আয় ও সম্ভাব্য আয়ের খবর বেশ প্রভাব ফেলেছে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রান্তিকে যেসব কোম্পানি ভালো আয় করেছে, স্বাভাবিকভাবে সেগুলোয় বিনিয়োগে আগ্রহ বেশি ছিল। এছাড়া যেসব কোম্পানির প্রতিবেদন অপ্রকাশিত রয়েছে, কিন্তু ভালো আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোয় নজর ছিল বিনিয়োগকারীদের।

এদিকে সপ্তাহজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রধান খাতগুলো। প্রধান খাতগুলোয়ে ভালো লেনদেন লক্ষ করা গেছে। গত সপ্তাহে খাতভিত্তিক লেনদেনে শীর্ষে ছিল বিবিধ খাত। ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল খাতটির দখলে। ১২ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওষুধ খাত। প্রকৌশল খাত ১১ দশমিক ৭ শতাংশ নিয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। পরের অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতের দখলে ছিল মোট লেনদেনের ৯ শতাংশ। পঞ্চম স্থানে থাকা সাধারণ বীমা খাতের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

ডিএসইতে খাতভিত্তিক ইতিবাচক রিটার্নে গত সপ্তাহে শীর্ষে ছিল ভ্রমণ ও অবকাশ খাত। খাতটিতে গত সপ্তাহে রিটার্ন এসেছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে সাধারণ বীমা এবং সেবা ও আবাসন খাত, ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতে ইতিবাচক রিটার্ন হয়েছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত সপ্তাহে ২ দশমিক ৩ শতাংশ নেতিবাচক রিটার্নের ভিত্তিতে শীর্ষে ছিল খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত।

এদিকে আলোচিত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ বা বাজার মূলধন বেড়েছে। সপ্তাহের শুরুতে এক্সচেঞ্জটির বাজার মূলধন ছিল পাঁচ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সপ্তাহ শেষে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে।

এদিকে গত সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৮৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের। এর মধ্যে দর বেড়েছে ২৩৫টির, কমেছে ১২৫টির ও অপরিবর্তিত ছিল ২৬টির।

সিংহভাগ সিকিউরিটিজের দর বৃদ্ধিতে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ বা ৬২ পয়েন্ট। সপ্তাহ শেষে সূচকটি সাত হাজার ৮৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল ৭ হাজার ২৪ পয়েন্ট।

গত সপ্তাহে ডিএসইর অন্য সূচকের মধ্যে নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএস৩০ সপ্তাহের ব্যবধানে ৫ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ৫৯৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল ২ হাজার ৫৯২ পয়েন্ট। শরিয়াহ্ সূচক ডিএসইএস ১৩ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ৫১৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আগের সপ্তাহ শেষে যা ছিল এক হাজার ৫০৪ পয়েন্ট।

সূচকের উত্থানে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি ল্যাবরেটরিজ, রেনাটা ও তিতাস গ্যাসের শেয়ার।

অন্যদিকে, পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা বিবেচনার ক্ষেত্রে সূচকের পাশাপাশি পিই রেশিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। পিই রেশিও হলো কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত। অর্থাৎ একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম এবং ওই কোম্পানির আয়ের অনুপাতের তুলনাটিই পিই রেশিও হিসেবে পরিচিত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, যে কোম্পানির পিই রেশিও যত কম, সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগে ঝুঁকিও তত কম। এ কারণে যেকোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ওই কোম্পানির পিই রেশিও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

সমাপ্ত সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) বেড়েছে। আগের সপ্তাহের চেয়ে পিই রেশিও বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৫ পয়েন্ট বা দশমিক ৯০ শতাংশ। ডিএসইর তথ্যমতে, আলোচ্য সপ্তাহে ডিএসইতে পিই রেশিও অবস্থান করছে ১৬ দশমিক ৮৯ পয়েন্টে। এর আগের সপ্তাহে ডিএসইর পিই রেশিও ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট।

খাতভিত্তিক হিসেবে পিই রেশিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, পিই রেশিওতে শীর্ষে অবস্থান করছে ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতের পিই রেশিও অবস্থান করছে ৮ পয়েন্টে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিমেন্ট খাতের পিই রেশিও ২৩ পয়েন্ট। ৩৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিরামিকস খাত। এ ছাড়া বাকি খাতগুলোর পিই রেশিও যথাক্রমে- প্রকৌশল ২২ দশমিক ৬ পয়েন্ট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২২ দশমিক ৪ পয়েন্ট, খাদ্য ২৫ দশমিক ৮ পয়েন্ট, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ১২ দশমিক ৪ পয়েন্ট, সাধারণ বিমা ২১ দশমিক ১ পয়েন্ট, আইটি ১৭ দশমিক ২ পয়েন্ট, পাট ৬৪৫ দশমিক ৩ পয়েন্ট, বিবিধ ১২ দশমিক ২ পয়েন্ট, মিউচুয়াল ফান্ড ৭ দশমিক ২ পয়েন্ট, কাগজ ও মুদ্রণ ৩৩ দশমিক ৪ পয়েন্ট, ওষুধ ও রসায়ন ১৭ দশমিক ২ পয়েন্ট, সেবা-আবাসন ২০ দশমিক ৪ পয়েন্ট, ট্যানারি ৫১ দশমিক ৭ পয়েন্ট, টেলিযোগাযোগ ১৮ দশমিক ৮ পয়েন্ট, বস্ত্র ১৭ দশমিক ৭ পয়েন্ট ও ভ্রমণ-অবকাশ খাতের পিই রেশিও ৬২ দশমিক ৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০