সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ২০১৯ সালের আগে গত ১৬ বছরে ১৪০টি জাহাজ নির্মাণ করেছে। যার মধ্যে ১১৫টি জাহাজ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যবহƒত হচ্ছে। বাকিগুলো বিদেশে রপ্তানি করেছে। কিন্তু গত তিন বছরে একটি জাহাজ রপ্তানি করতে পারেনি। উল্টো প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তাদের উদাসীনতার কারণে মূলধন সংকট, নতুন করে অর্ডার না পাওয়া, চলমান প্রকল্পে ধীরগতি, ব্যাংক লোন পরিশোধে ব্যর্থতা, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি কারণে বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। এসব বিষয় নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের ফাটলের প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। ফলে প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তারা নিজ নিজ ব্যবসায় মনোযোগী। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তের দিকে যাচ্ছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০০০ সালে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড জাহাজ নির্মাণ শিল্পে যাত্রা শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যে দেশের রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তালিকায় ওঠে আসে। আর সাফল্যের ধারাবাহিতকায় পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয় ২০১৪ সালে। যদিও নিবন্ধিত হওয়ার আগ থেকে প্রতিষ্ঠানটি নানা সংকটে আক্রান্ত ছিল। তখন প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ ছিল ৬৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু একই সময়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে নেয়া হয় ৪৫ কোটি টাকা।
এরপর থেকে গত ৩০ জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আর্থিকপ্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া হয় প্রায় ৯৪৬ কোটি টাকা। এ বিপুল পুঁজি সংগ্রহের পরও প্রতিষ্ঠান কোনো কোনো আর্থিকপ্রতিষ্ঠানে খেলাপি তালিকায় নাম উঠে আসে। চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা হয়, পাওনা পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থ হয়, নগদ প্রবাহে সংকট, প্রকল্প কাজে ধীরগতি, নতুন করে অর্ডার না পাওয়া, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি দেখা দেয়। এমনকি পাওনাদারদের সহজে দেখা না দেয়ার জন্য একাধিকবার অফিসও পরিবর্তন করে। এসব কারণে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের ফাটলের প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়।
সূত্রমতে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কোম্পানিটির মোট সম্পমূল্য ছিল ৬০১ কোটি টাকা। একই সময়ে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল ছিল ৩০ টাকা ১৬ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ২ টাকা ৭৫ পয়সা। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল কমে দাঁড়ায় ২২ টাকা ৮১ পয়সা এবং শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল চার পয়সা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষিত লভ্যাংশও দিতে পারেনি কোম্পানিটি। এতে বিনিয়োগকারীরা পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে।
অথচ কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন দেশের চামড়া খাতের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পিকার্ড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম। যিনি নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপবিল্ডিং লিমিটেড, বঙ্গ ড্রেজার লিমিটেড, সারু হিল রিসোর্ট লিমিটেড, সুবর্ণভূমি রিসোর্ট, ফুটস্টপ বাংলাদেশ লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। কিন্তু ওয়েস্টার্ন মেরিন পরিচালনায় তিনি সাফল্য দেখাতে পারছেন না। একইভাবে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান। তিনি সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সিঙ্গাপুরে ব্যবসাও রয়েছে তার। এছাড়া শাহ আলম বাবুল, শাখাওয়াত হোসেন, আবদুল মুবিনসহ অন্যান্য পরিচালকরা নিজেদের ব্যবসায় ভালো করলেও ওয়েস্টার্ন মেরিনের বেলায় বরাবরাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে লেনদেন আছে এমন একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা শেয়ার বিজকে বলেন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড নিয়মিত পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করছে। এ কোম্পানির কাছে সুদে-আসলে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। নিয়মিত পরিশোধ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক সুদও বাড়ছে। পাওনা আদায়ে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা গেলেও কোনো আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে উদ্যোক্তারা ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক, তারা এ কোম্পানি নিয়ে উদাসীন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ নষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের মোট পরিশোধিত ২৩৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সাধারণ শেয়ার সংখ্যা ২৩ কোটি ৫২ লাখ। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার সংখ্যা ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। গত ১ নভেম্বর শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০ হাজার ১২৫টি। এদিন সর্বোচ্চ দর ও সর্বনি¤œ দর ছিল ১১ টাকা। অর্থাৎ শেয়ারটি ফ্লোরপ্রাইসে লেনদেন হচ্ছে। আর গত কয়েক মাস ধরে ফ্লোরপ্রাইসে লেনদেন হচ্ছে। এছাড়া গত অর্থবছরের ঘোষিত লভ্যাংশ এখনও পরিশোধ করতে পারেনি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, করোনা আর বিশ্বমন্দার কারণে এখন বৈশ্বিক অর্ডার কম। আগের কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন করে তেমন কার্যাদেশ নেই। তাই লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে দ্রুত ইউরোপ থেকে আমরা একটা কার্যাদেশ পাব। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে যদি আমরা চলতি মূলধন পাই, তাহলে আমরা আগের মতো ঘুরে দাঁড়াব।