কৌশলে কর ফাঁকি গ্রামীণফোনের

রহমত রহমান: করযোগ্য আয় হলেও তা করযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়নি। প্রতিষ্ঠান সেই আয়ের ওপর কর পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০-২১ করবর্ষে দুটি খাতে প্রায় ১৬ কোটি টাকা আয় গোপন করেছে, যাতে পরিশোধ করেনি প্রায় ছয় কোটি ৪৩ লাখ টাকার আয়কর।

আবার অননুমোদনযোগ্য খরচ হলে তা প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট আয় নিরূপণ করতে হয়। তা করেনি আয়কর অফিস। ফলে সরকারের এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়ম উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) আয়করের আওতাধীন করদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০-২১ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। এই রিটার্ন, বার্ষিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য কাগজপত্র নিরীক্ষা করেছে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। এতে দেখা গেছে, গ্রামীণফোন রিটার্নে ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছে ছয় হাজার ৬৫০ কোটি পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯৬৫ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ওই করবর্ষে দুটি করযোগ্য খাতে কর পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে অনুযায়ী, নিরীক্ষার সময় প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা ‘কম্পিউটেশন অব ট্যাক্সেবল ইনকাম অ্যান্ড ইনকাম ট্যাক্স লায়াবিলিটি’তে প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন ও চালানপত্র পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, অননুমোদনযোগ্য খরচ প্রতিষ্ঠানের আয় হিসাবে যোগ না করে আয়কর কম নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামীণফোনের বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-২১.১-এ ‘অ্যাসেট রিটায়ারমেন্ট অবলিগেশন (এআরও)’ খাতে চলতি করবর্ষে ৮১ লাখ ১৬ হাজার টাকা প্রভিশন করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এ খাতে কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি।

এই টাকা ভবিষ্যতে পরিশোধের আশায় অতিরিক্ত প্রভিশন করা হয় এবং আয়কর দায় নির্ধারণকালে আয়ের সঙ্গে যোগ না করেই আয়কর নির্ধারণ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ২৯ ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের প্রভিশনকৃত খরচ বিয়োজন অনুমোদনযোগ্য নয়। ফলে প্রভিশনকৃত এই খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ, যা প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট আয় নিরূপণযোগ্য।

অন্যদিকে নিরীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-৩০-এ ‘সেলস, মার্কেটিং অ্যান্ড কমিশনস’ খাতে কমিশন বাবদ এক হাজার ১৭৭ কোটি ৫৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩ই(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে পণ্য বিতরণ বা বিপণন বাবদ কমিশন, ডিসকাউন্ট, ফি, ইনসেনটিভ বা পারফরম্যান্স বোনাস বা পারফরম্যান্স-সংক্রান্ত প্রণোদনা বা অনুরূপ প্রকৃতির অন্য যেকোনো পরিশোধ প্রদানকালে এই পরিশোধকৃত অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য ১১৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ টাকা। কর নথির সমর্থনে ৩৪টি চালানে কর্তন ও জমা হয়েছে ১১৬ কোটি ২৩ লাখ দুই হাজার ৭৪ টাকা।

বাকি এক কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ১২৬ টাকা, যা আনুপাতিক হারে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার ২৬০ টাকা। আয়কর অধ্যাদেশের ৩০(এএ) ধারা অনুযায়ী এই খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ, যা প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যোগ করে মোট আয় নিরূপণযোগ্য।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান এই দুই খাতে কম দেখিয়ে গোপন করেছে ১৬ কোটি সাত লাখ ৫৭ হাজার ২৬০ টাকা। ২০২০-২১ করবর্ষের আয়কর পরিপত্র অনুযায়ী, ওই করবর্ষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা থেকে আয়ের ওপর প্রযোজ্য কর ৪০ শতাংশ। ফলে ১৬ কোটি সাত লাখ ৫৭ হাজার ২৬০ টাকার ওপর প্রযোজ্য আয়কর ছয় কোটি ৪৩ লাখ দুই হাজার ৯০৪ টাকা, যা গ্রামীণফোন পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে এলটিইউ’র কাছে জবাব চাওয়া হলে এলটিইউ জানায়, আয়কর রেকর্ড যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। তবে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানানো হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গ্রামীণফোন লিমিটেডের সঙ্গে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। বক্তব্যের বিষয় নির্দিষ্ট করে লিখিত আকারে দেয়া হয়। তবে যে দুটি খাতে ফাঁকি দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে শেয়ার বিজকে জানানো হয়, ‘গ্রামীণফোন দেশের প্রাসঙ্গিক কর আইন মেনে নির্দিষ্ট সময়ে কর পরিশোধ করতে সংকল্পবদ্ধ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা এখনও কোনো নোটিশ পাইনি। অতএব এই মুহূর্তে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০