Print Date & Time : 28 June 2025 Saturday 3:37 pm

কৌশলে ভ্যাট-আবগারি শুল্ক ফাঁকিতে সাউথইস্ট ব্যাংক

রহমত রহমান: পুঁজিবাজারের ব্যাংকিং খাতে তালিকাভুক্ত বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের বিরুদ্ধে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। সম্প্রতি ব্যাংকটির বিরুদ্ধে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। তবে সাউথইস্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি তথ্যের গরমিল, ফাঁকি নয়।
সূত্র জানায়, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন কর শাখায় ভ্যাট নিবন্ধিত। ব্যাংকটি ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেÑএমন তথ্যের ভিত্তিতে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় এলটিইউ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ পরিদর্শন দল চলতি বছরের ২৫ জুলাই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে। পরিদর্শনের সময় ব্যাংকের মে, ২০১৮ করমেয়াদের ৩১ মে পর্যন্ত সমন্বিত হিসাব এবং লাভ-ক্ষতি (প্রফিট অ্যান্ড লস) সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকের প্রায় তিন কোটি ৩১ লাখ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করার কথা। কিন্তু একই করমেয়াদে দাখিলপত্রে সাউথইস্ট ব্যাংক ভ্যাট দেখিয়েছে প্রায় দুই কোটি ৫৪ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৭ লাখ টাকার ভ্যাট কম পরিশোধ করে ফাঁকি দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আমানত থেকে আবগারি শুল্ক কর্তন করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সাউথইস্ট ব্যাংকের সমন্বিত হিসাব ও লাভ-ক্ষতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রযোজ্য আবগারি শুল্ক প্রায় ৫০ লাখ টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংক প্রায় তিন লাখ টাকা কম পরিশোধ করে ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট ও আবগারি শুল্কের প্রায় ৮০ লাখ টাকার রাজস্ব পরিশোধে গত ২৮ জুন এলটিইউ কমিশনার মো. মতিউর রহমান সই করা প্রাথমিক দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন সই করা নোটিসের লিখিত জবাব দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, সাউথইস্ট ব্যাংক ১৩২টি শাখার মাধ্যমে সারা দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিভিন্ন সরবরাহকারীর কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করে পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখ ট্রেজারি চালানে সরকারি কোষাগারে জমা করে। এলটিইউ পরিদর্শন দল সমন্বিত হিসাব পর্যালোচনার সময় পরিশোধযোগ্য ভ্যাট গণনার সময় মূল খাত ও উপ-খাত হিসেবে দুইবার বিবেচনা করে ভ্যাট প্রায় ৭৭ লাখ টাকা অপরিশোধ বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক এ ভ্যাট পরিশোধ করেছে। প্রতিবেদন পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়েছে।

আবগারি শুল্ক বিষয়ে বলা হয়, আমানত হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় অনেক সময় হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক কর্তন সম্ভব হয় না। এটি পাওনা দাবি হিসাবে প্রদর্শন করা হয়। যেসব হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক কর্তন সম্ভব হয় না, সেসব ক্ষেত্রে ব্যাংক রিসিভ এক্সসাইজ ডিউটি খাত থেকে নেওয়া হয়। পরে সমন্বয় করা হয়। আবগারি শুল্ক ফাঁকি হয়নি বলে দাবি করা হয়।

এ বিষয়ে সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ফাঁকি নয়, ব্যাংক ফাঁকি দিতে পারে না। তথ্যের গরমিল হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, এর আগেও সাউথইস্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে এলটিইউ। এর মধ্যে ব্যাংকটির অ্যাডভান্স রেন্টের ওপর দুই কোটি ৫৩ লাখ টাকা, দাখিলপত্র যাচাই করে ৩৭ লাখ টাকা ও আবগারি শুল্ক বাবদ দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকার ফাঁকি উদঘাটন করে। সাউথইস্ট ব্যাংক আবগারি শুল্ক ও দাখিলপত্র যাচাই করে উদঘাটন করা ফাঁকির রাজস্ব পরিশোধ করলেও অ্যাডভান্স রেন্টের ওপর ফাঁকি দেওয়া দুই কোটি ৫৩ লাখ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এছাড়া ব্যাংকটির বিরুদ্ধে এলটিইউ দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা ফাঁকির মামলা করেছে, যা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন। ২০১০-১২ অর্থবছরে ব্যাংকটি ৩৮ কোটি পাঁচ লাখ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে, যা নিষ্পত্তির পর পরিশোধ করেছে ব্যাংকটি।

এনবিআর সূত্র জানায়, ভ্যাট ফাঁকি ছাড়াও সাউথইস্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এনবিআর ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরের নিরীক্ষায় সাউথইস্ট ব্যাংকের কর ফাঁকি ৩৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা উদঘাটন করা হয়। অনুমোদনযোগ্য খরচকে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ না করে এ ফাঁকি দিয়েছে। নিরীক্ষায় প্রকাশিত এসব আপত্তি নিয়ে মামলায় নি¤œ আদালত ব্যাংকগুলোর পক্ষে রায় দিলেও এনবিআরকে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে বলেছে সংসদীয় সরকারি হিসাব কমিটি।

সূত্র জানায়, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে এলটিইউ ২০১২-১৩ অর্থবছর ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক বাবদ ২৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আদায় করেছে। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৩৬ কোটি ৫১ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৪০ কোটি ৮৩ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৫২ কোটি ২৭ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৬১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আদায় করেছে।

উল্লেখ্য, ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন প্রায় ৯১৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আর ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৩২ দশমিক ৩৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছয় দশমিক ৮০ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩০ দশমিক ৯০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৩ সালে বোনাস ও নগদ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এ সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা কমে ১১৬ কোটি টাকায় নেমেছে।