ক্যানসারের আছে অ্যানসার

ক্যানসার শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত। আমাদের ধারণা, ক্যানসারের কোনো চিকিৎসা নেই। এ রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু অবধারিত। তবে সেই অবস্থা কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগে ক্যানসার রোগটিও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
দুই হাজার ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে হিপোক্রেটাস লক্ষ করেন কিছু শিরা টিউমারের চারপাশে ছড়িয়ে গেছে মনে হতো যেন একটি কাঁকড়া। এ থেকে গ্রিক ভাষায় ‘কারকিনোমা’ এবং পরে ল্যাটিন ভাষায় ‘ক্যানসার’ নামের উৎপত্তি। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ‘ঋকবেদ’ ও ‘অথর্ব বেদ’-এ এর উল্লেখ আছে। ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিসরীয়রাও লক্ষ করেছিল কিছু অস্বাভাবিক টিউমার ও তার অস্বাভাবিক আচরণ।
কোনো টিসুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যা পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক টিস্যুর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এবং প্রারম্ভিক স্টিমুলেশন বন্ধ হয়ে গেলেও ওই টিস্যুর আগ্রাসী বৃদ্ধি বন্ধ হয় না, এমন কোনো টিউমারই প্রকৃতপক্ষে ক্যানসার।
সাধারণভাবে বললে একশরও বেশি সংখ্যক রোগ পাওয়া যাবে যাদের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ লোক ক্যানসারে ভুগছে। প্রতি বছর এখানে দুই লাখ ৫০ হাজার লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এক লাখ ৫০ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আট মিলিয়নের বেশি লোক ক্যানসারে আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগের পরেই ক্যানসারের অবস্থান।

কারণ
আসলে ক্যানসারের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই, তবে বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে।
রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে ধূমপান, বিকিরণ, সূর্যালোক অর্থাৎ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, কিছু রাসায়নিক পদার্থ, কতগুলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া, কিছু হরমোন, মদ, বয়স বৃদ্ধি, পারিবারিক ইতিহাস, অপুষ্টি, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত ওজন প্রভৃতি। তবে এর সবকটিই ক্যানসার ঘটায় না। ক্যানসার কোনো আঘাতজনিত কারণে হয় না। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। আপনার কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলেই যে আপনি ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন তাও কিন্তু নয়। দেখা গেছে রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে এমন অনেক লোক কখনোই ক্যানসারে আক্রান্ত হননি। আবার অনেকেই এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। ফলে তারা সহজে ক্যানসারে আক্রান্ত হন।
সাধারণভাবে ক্যানসারের বিপদ সংকেত বললে কী বুঝব?

খুসখুসে কাশি বা ভাঙা কণ্ঠস্বর। সহজে সারছে না এমন কোনো ক্ষত

অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। স্তনে বা শরীরের অন্য কোথাও পিণ্ডের সৃষ্টি

গিলতে অসুবিধা বা হজমের গণ্ডগোল। মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন

তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন

সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য আমরা যা করতে পারি

ক্যানসারের যে কোনো বিপদ সংকেত দু’সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া

প্রতি বছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো

নারীদের প্রতি মাসে স্তন পরীক্ষা করা

জরায়ু ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শমতো ‘প্যাপটেস্ট’ করানো

অন্ত্রের ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ‘এন্ডোস্কপি’
করানো প্রভৃতি

প্রতিরোধে করণীয়

ধূমপান বিষপান। ধূমপান ত্যাগ করুন

তামাকপাতা ও এটি থেকে তৈরি জর্দা, দোক্তা, কিমাম প্রভৃতি মুখ ও গলার ক্যানসারের জন্য দায়ী, তাই তামাক
বর্জন করুন

শুধু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য
বর্জন করলে ফুসফুসের ৮৫ ভাগ ক্যানসারসহ বাংলাদেশের ৪০ ভাগ ক্যানসার কমানো সম্ভব

মদ্যপানে যকৃৎ, খাদ্যনালি ও গলার ক্যানসার হয়, তাই মদ্যপান নয়

অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য ও যখন-তখন খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। খাদ্যতালিকায় আঁশযুক্ত খাবার, ভিটামিন এ, সি ও ই, জিঙ্ক, সেলেনিয়ামযুক্ত খাবার সংযোজন করুন

অধিক সন্তান প্রসব ও বহুগামিতা জরায়ু ক্যানসারের অন্যতম কারণ। অতএব
কম সন্তানধারণ ও নিরাপদ যৌন জীবনযাপন করুন

নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। ওজন পরিমিত রাখুন। মন চিন্তামুক্ত রাখুন। পর্যাপ্ত নিদ্রা ও বিশ্রাম করুন

চিকিৎসা

শুধু অভ্যাস পরিবর্তন ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব

এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসার নিরাময় করা সম্ভব। সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি হরমোনথেরাপি, ইমিউনথেরাপি প্রভৃতির সাহায্যে অনেক ধরনের ক্যানসার নিরাময় সম্ভব

এক-তৃতীয়াংশ অনিরাময়যোগ্য
ক্যানসারের ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গের উপশম করা সম্ভব।

প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা

প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বিশ্ব ক্যানসার দিবস

ঝুঁকি কমানোর জন্য উইলট, ক্লোডিজ ও মুলার এই তিন বিজ্ঞানী চার ধাপবিশিষ্ট একটা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন।
এগুলো হচ্ছে
প্রথম স্তর বা ব্যক্তিপর্যায়: এই বিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তিগত আচরণসহ অনেক ব্যবস্থাই ব্যক্তিপর্যায়ে নেওয়া যেতে পারে, যা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে
দ্বিতীয় স্তর: যারা ক্যানসার রোগের চিকিৎসক এবং বিভিন্ন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা তারা স্বাস্থ্যসেবা, মতবিনিময়, আলোচনা ও বাছাইকরণ বা স্ক্রিনিং পদ্ধতির মাধ্যমে এগিয়ে আসতে পারেন
তৃতীয় স্তর: জাতীয় পর্যায়ে সরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন আইনের সহায়তায় ক্ষতিকারক পদার্থের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতি করতে পারে
চতুর্থ স্তর: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্য এবং ক্ষতিকারক বর্জ্য ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থের ব্যবহার, বহন, উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে ক্যানসারসহ অনেক রোগের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এভাবে বহুমাত্রিক সমাজে নানা ধরনের কর্মসূচি জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও ক্যানসার চিকিৎসার নয়াদিগন্ত খুলে দিতে পারে।
সচেতন হোন সুস্থ থাকুন।

ডা. কাজী মুশতাক হোসেন
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ক্যানসার বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০