জানুন প্রকৃত তথ্য
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা ক্যানসার সম্পর্কে অনেকে অনেককিছু জানি। আমাদের জানা সব তথ্যই কি সঠিক? না, বিষয়টি তা নয়। আমরা অনেক ভুল তথ্য পাই, যা আমাদের বিভ্রান্ত করে, ভুল পথে পরিচালিত করে। এখানে আমরা ক্যানসার সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা করব। এ ব্যাপারে আপনি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আরও বিশদ ধারণা পেতে পারেন। শুরুতেই বলে রাখি, ক্যানসার মিথ বা ক্যানসার সম্পর্কে ভুল ধারণা ভেঙে বেরিয়ে আসুন।
ক্যানসার ছোঁয়াচে রোগ
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়। তবে কিছু ক্যানসার ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যমে হয়, সেগুলোকে ছোঁয়াচে বলা যেতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারলে এ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
পরিবারের কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত না হলে আপনার ক্যানসার হবে না
প্রকৃত তথ্য: মাত্র পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ক্যানসার বংশগত। বেশিরভাগ ক্যানসার জিন মিউটেশনের ফলে হয়। বিকিরণ, তামাক ও কিছু রাসায়নিক পদার্থ এজন্য দায়ী। তাই আমরা সবাই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছি।
পরিবারের কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে আপনারও ক্যানসার হবে এবং এটা ঠেকানো যাবে না
প্রকৃত তথ্য: পরিবারের কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে আপনারও ক্যানসার হতে পারে, কিন্তু হবেই এমনটি নয়। আপনার ঝুঁকি কিছুটা বেশি হলেও এটা কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। বরং কিছু নিয়ম মেনে চললে বেশিরভাগ ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন পরিমিত খাদ্যগ্রহণ, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম করলে এবং ধূমপান ও মদ্যপান করা থেকে বিরত থাকলে অনেক ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এমনকি পারিবারিক ক্যানসারের ঝুঁকি থাকলে আগাম চিকিৎসা নিয়ে সেসব ক্যানসারকেও প্রতিরোধ করা যায়।
চুলে ব্যবহার করা রং বা দুর্গন্ধনাশক বা ঘাম প্রতিরোধক ব্যবহার করলে ক্যানসার হতে পারে
প্রকৃত তথ্য: তথ্যটি ভুল। এ ব্যাপারে প্রমাণিত কোনো তথ্য নেই। ১৯৮০ সাল নাগাদ এ রকম একটা ধারণা করা হয়েছিল যে চুলের রং বা দুর্গন্ধনাশক ব্যাবহার করলে ‘নন-হজকিন্স লিম্ফোমা’ হতে পারে। এর পরপরই সন্দেহজনক সেসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ক্যানসার হয়েছে এটা না জানাই ভালো বা ডাক্তারের কাছে না যাওয়াই ভালো
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার হয়েছে শুনলে যে কেউই ভীত হয়ে পড়েন। তাই বলে সন্দেহ হলে ঘরে বসে থাকা উচিত নয়, কেননা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই আপনি চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করলে অনেক ধরনের ক্যানসার সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়।
নিডল বায়োপসি করালে ক্যানসার শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এর সঙ্গে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার কোনো প্রমাণ নেই। এ ব্যাপারে ডাক্তার সচেতন থাকেন। শুধু টেস্টিসের ক্ষেত্রে এটি করানো হয় না।
ইতিবাচক চিন্তা করলে ক্যানসার ভালো হয়ে যায়
প্রকৃত তথ্য: ইতিবাচক চিন্তার ফল অবশ্যই ভালো, কিন্তু এজন্য যে ক্যানসার ভালো হয় এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং রোগ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলে এটা আপনাকে অপরাধবোধে আক্রান্ত করতে পারে বা ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
চিনি খাওয়া বাদ দিলে ক্যানসার ভালো হয় বা ছড়ায় না
প্রকৃত তথ্য: এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, চিনি ক্যানসারে আক্রান্ত করে, কিংবা চিনি বর্জন করলে ক্যানসার ভালো হয়। শরীরের অন্য কোষগুলোর মতোই ক্যানসার কোষ চিনি গ্রহণ করে। তবে অতিরিক্ত চিনি বা শর্করা গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
ক্যানসার ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অনেক ধরনের ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।
ক্যানসার মানেই তীব্র ব্যথায় কষ্ট পাওয়া
প্রকৃত তথ্য: সঠিক নয়। শুরুতে বরং ব্যথা হয় না বললেই চলে। বলা যায়, ৯৫ শতাংশ ব্যথা চিকিৎসার সাহায্যে কমানো যায়।
বয়স্ক ব্যক্তির চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা নাই। বয়স্ক ব্যক্তিরাও চিকিৎসা করলে অল্পবয়সীদের মতোই সুফল পেতে পারেন। তবে তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ওষুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। যদি অন্য কোনো অসুখ থাকে, তাহলে সেটা বিবেচনা করেই ওষুধ নির্বাচন করা হয়।
ক্যানসার রোগের চেয়ে এর চিকিৎসা আরও খারাপ
প্রকৃত তথ্য: ক্যানসার চিকিৎসার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু সেটা ক্যানসারের চেয়ে খারাপ নয়, এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও চিকিৎসা আছে। বর্তমানে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম। রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে।
ক্যানসার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা চলাকালে কোনো কাজকর্ম করতে পারে না
প্রকৃত তথ্য: চিকিৎসা চলাকালে ব্যক্তিগত, ঘরের বা সামাজিক কাজÑসবই করা যায়। কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে থাকতে হয় না।
প্রত্যেক ক্যানসার রোগীরই চিকিৎসা করা প্রয়োজন
প্রকৃত তথ্য: কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসা না নিয়ে পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়, রোগ বাড়লে চিকিৎসা নিতে হয়। আবার রোগের বৃদ্ধির পর্যায়ে কোনো সক্রিয় চিকিৎসা না দিয়ে কষ্ট লাঘবের জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়।
নিয়মিত চেকআপ করলে সব ক্যানসার সূচনাতেই ধরা পড়ে
প্রকৃত তথ্য: সব ধরনের ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য স্ক্রিনিং টেস্ট নেই। জরায়ু, স্তন ও অন্ত্রের ক্যানসার স্ক্রিনিং করে সহজেই সূচনাতে নির্ণয় করা যায় এবং অন্য ক্যানসারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া যায় বা রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা যায়।
ওষুধ কোম্পানি কিংবা চিকিৎসকরা অনেক সময় নতুন ওষুধ আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেন না
প্রকৃত তথ্য: প্রকৃতপক্ষে নতুন ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পর বাজারে আসার আগে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। মানুষের শরীরে এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোনো কোম্পানি বাজারে ওষুধ সরবরাহ করে না। অনেক সময় আবিষ্কারের কথা আমরা আগে জানতে পারি। তাই এটা মনে হতে পারে যে, ইচ্ছা করেই দেরি করা হচ্ছে; কিন্তু তা সত্য নয়।
ডা. কাজী মুশতাক হোসেন
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ক্যানসার বিভাগ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল