ইসমাইল আলী: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রিতে কৌশলে নানা সুবিধা আদায় করছে আদানি। ভারতে শুল্ক-কর ছাড় পাওয়ার পরও তা গোপন রেখে বেশি হারে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করছে কোম্পানিটি। এছাড়া নিম্ন শ্রেণির কয়লা কিনলেও উচ্চ শ্রেণির কয়লার দামের আনুপাতিক হারে মূল্য আদায় করতে চায় আদানি পাওয়ার। এতে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কয়লার দাম কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেশি নিতে চায় ভারতের এ কোম্পানিটি।
সূত্রমতে, আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসার কয়েক মাস আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি তোলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে কয়লার দাম প্রায় দ্বিগুণ চেয়েছিল আদানি। তবে ওই দামে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবি রাজি না হওয়ায় তারা দাম কিছুটা কমাতে রাজি হয়। এক্ষেত্রে পায়রা, রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্রয়কৃত কয়লার দামের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে দশমিক ০১ (০.০১) সেন্ট কম নেয়ার কথা জানায় কোম্পানিটি।
এক বছরের জন্য এ মূল্য রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি। সে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পিডিবির পক্ষ থেকে কয়লার দাম পর্যালোচনায় আদানিকে চিঠি দেয়া হলেও তারা বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়লার দাম নির্ধারণে একাধিকবার বৈঠক করে পিডিবি ও আদানি। এ বিষয়টি নিয়ে গতকালও আদানির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন পিডিবির কর্মকর্তারা।
বৈঠকে আদানির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে ৬৩০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার প্রতি টন কয়লার দাম ১২৭ দশমিক ৭২ ডলার। চুক্তির শর্তানুসারে তাই ৪৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লা ব্যবহার করলে দাম দিতে হবে প্রতি টনের জন্য ৯৩ দশমিক ২৫ ডলার। তবে পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া কোল ইনডেক্সে ৪৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লার প্রতি টনের দাম ৭২ দশমিক ২৪ ডলার। অর্থাৎ আদানি প্রতি টন কয়লার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি চাচ্ছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, আদানির পক্ষ থেকে কয়লার দাম বাড়তি চাওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই। তবে গত বছর কয়লার দাম কমানোর সময়ই তারা ইঙ্গিত দিয়েছিল এ সিদ্ধান্তের মেয়াদ বাড়বে। তাই এখন কয়লার বাড়তি দাম চাইলেও সে সুযোগ আদানি পাবে না। এদিকে গতকাল বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদানিকে কয়লার দাম কমানোর জন্য দুই মাস আগে চিঠি দেয়া হলেও তারা ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। তারা যুক্তি দেন, এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজিপ্রতি দাম এক হাজার ৮০০ টাকা হলে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজিও কি একই দাম হবে? কখনোই না, বরং ৬০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা হতে পারে। যদিও আনুপাতিক হারে হিসাব করলে এ দাম এক হাজার ৮০ টাকা হওয়ার কথা। অনেকটা এ সূত্রেই দাম চাইছে আদানি।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে কম দামে কয়লা আমদানি করে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কয়লা কেনায় ভালো ডিসকাউন্ট পায়। তবে রামপালের কয়লা সরবরাহের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে বসুন্ধরা। এতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কয়লা কেনায় রামপালে দাম বেশি পড়ে। আর আদানি ওই বেশি মূল্যকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। তাই রামপালকে বাদ দিয়ে আদানির কয়লার দাম নির্ধারণ করা দরকার। অন্যদিকে গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। এতে কমবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয়। চুক্তির ১৩.১-এর (ই) ধারায় বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার অ্যাজাম্পশনগুলো (ট্যাক্স ও ভ্যাটের হার) কোনো পরিবর্তন হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ?উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) জানাবে। যদিও তা করেনি আদানি। মূলত বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার দাম নেয়ার জন্য প্রতারণা করেছে কোম্পানিটি।
আদানির সঙ্গে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) ঘেঁটে দেখা যায়, চুক্তির ১৩.২-এর (সি) ধারায় ক্যাপাসিটি চার্জের কথা বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের হার লেখা হয়েছে পিপিএ’র শেষে শিডিউল-৬-এর টেবিল-এতে। পিপিএ’র ১৩.১-এর (ডি) ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে কতগুলো অ্যাজাম্পশনের (শর্ত) ভিত্তিতে, যার একটি কর ও শুল্ক সংক্রান্ত। আর কর ও শুল্ক ভারতের করহার নীতির ওপর নির্ভরশীল থাকবে। ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এসইজেড ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদানি পাওয়ার সব ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আদানি মোট আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। যার মধ্যে রয়েছেÑচীন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও গ্রিস। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৯৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি করে আদানি।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা আমদানিতে শুল্ক ও সব ধরনের কর ছাড় পেয়েছে আদানি। এছাড়া কোম্পানিটিকে কোনো ধরনের গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি), সারচার্জ বা অন্য কোনো শুল্ক-কর দিতে হবে না। সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চললে বছরে লাগবে সাত থেকে ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা। ফলে শুধু কয়লা আমদানিতেই আদানি শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ভারতের রাজ্য সরকার কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রতি টন কয়লার ওপর ৪০০ রুপি বা চার দশমিক ৮৮ ডলার কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে। এ ট্যাক্সও ছাড় পেয়েছে আদানি। বছরপ্রতি আট মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা ধরলে বছরে কোম্পানিটি ছাড় পাবে প্রায় ৩৯ দশমিক শূন্য দুই মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে তারা ছাড় পাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
ভারতের সংবাদমাধ্যম আরও জানিয়েছে, এসইজেড ঘোষণার ফলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা পাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির জন্য আদানির সাড়ে ১২ শতাংশ কাস্টম শুল্ক ও আবগারি শুল্ক, নির্মাণ কাজের জন্য ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের বাইরে থেকে পণ্যসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কেন্দ্রীয় বিক্রয় শুল্ক, ঠিকাদারের বিলের ৪০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কম্পোজিট ট্যাক্স, সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এক শতাংশ কল্যাণ ট্যাক্স, চার শতাংশ কর্মচুক্তি ট্যাক্স, ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকারকে পানির ব্যবহার চার্জ ও আয়কর দেয়ার কথাও ছিল। তবে এসব শুল্ক ও কর মওকুফ পেয়ে গেছে আদানি। তবে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দিচ্ছে না আদানি।
প্রসঙ্গত, আদানির কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।