বর্তমান সরকার ২০১০ ও ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে। তবে বিলাসী সেসব মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে হোঁচট খায় সরকার। এতে সংশোধন করা হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। এজন্য সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি) ২০২৩-এর খসড়া এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়ার কপি শেয়ার বিজের কাছে এসে পৌঁছেছে। এর খুঁটিনাটি নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই কম গুরুত্ব দেয়া হয়। এরপরও ২০২১ সালের মধ্যে এ খাত থেকে দুই হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে ২০২৩ সালে এসেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে বিদ্যুৎ আসছে মাত্র ২৫৯ মেগাওয়াট। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি এসব কেন্দ্রের জন্য কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় না।
এদিকে ‘সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (আইইপিএমপি) ২০২৩’-এর খসড়াতেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানটি মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৫০ সাল নাগাদ উৎপাদিত বিদ্যুতের শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত আইইপিএমপিতে ২০৫০ সালে উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশের কম আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে।
আইইপিএমপি ২০২৩ নিয়ে সম্প্রতি এক নীতি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে উপকূলীয় পরিবেশ ও জীবনযাত্রা কর্মজোট (ক্লিন) এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি)। এতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকারের মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশ ও ২০৫০ সাল নাগাদ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বিগত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ আইইপিএমপিতে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি (বিশেষত কয়লা ও এলএনজি), ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ তথাকথিত ‘উন্নততর প্রযুক্তি’ (বিশেষত তরল হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও কার্বন সংরক্ষণ প্রযুক্তি) এবং মাত্র ১৭ দশমিক ১ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মাস্টারপ্ল্যানের খসড়ার তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস/এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার ৫২২ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানিচালিত (ডিজেল/ফার্নেস অয়েল) কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার ৬১৯ মেগাওয়াট এবং কয়লাচালিত কেন্দ্রের সক্ষমতা দুই হাজার ৬৯২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৪৯ শতাংশ গ্যাস/এলএনজির, ৩২ শতাংশ তরল জ্বালানির এবং ১১ শতাংশ কয়লার। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। আর হাইড্রো পাওয়ার থেকে আসে ২৩০ মেগাওয়াট ও নবায়নযোগ্য উৎস (বায়ু/সৌর) থেকে ২৫৯ মেগাওয়াট।
এদিকে ২০৩০ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৮ হাজার ৮৯৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস/এলএনজি থেকে আসবে ১৫ হাজার ৮৩৬ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে পাঁচ হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট এবং কয়লা থেকে আট হাজার ২৬০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস/এলএনজির, ১৪ শতাংশ তরল জ্বালানির এবং ২১ দশমিক ২ শতাংশ হবে কয়লার। এছাড়া ভারত থেকে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট। আর নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে তিন হাজার ৯০৫ মেগাওয়াট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দুই হাজার ৬০ মেগাওয়াট এবং হাইড্রো পাওয়ার থেকে আসবে ২৩০ মেগাওয়াট।
খসড়ার তথ্যমতে, ২০৪১ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ৭৪ হাজার ২৫৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস/এলএনজি থেকে আসবে ৩০ হাজার ৭৮৪ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে দুই হাজার ৪২৬ মেগাওয়াট এবং কয়লা থেকে ১০ হাজার ৮৬৮ মেগাওয়াট। এছাড়া ভারত থেকে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। আর নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে ১১ হাজার ১৮৫ মেগাওয়াট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চার হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট এবং হাইড্রো পাওয়ার থেকে আসবে ৮৩০ মেগাওয়াট। ২০৪১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি হিসেবে যুক্ত হবে হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া। এ দুই জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে চার হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট।
সর্বশেষ ২০৫০ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে এক লাখ ১১ হাজার ১৩৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস/এলএনজি থেকে আসবে ২৯ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে ছয় হাজার ৭০০ মেগাওয়াট এবং কয়লা থেকে ১১ হাজার ৪৬৮ মেগাওয়াট। এছাড়া ভারত থেকে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। আর নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে ২৬ হাজার ২৩০ মেগাওয়াট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চার হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট এবং হাইড্রো পাওয়ার থেকে আসবে এক হাজার ১৩০ মেগাওয়াট। এছাড়া হাইড্রোজেন ও অ্যামোনিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং পাঁচ হাজার ৪৪ মেগাওয়াট।