ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তথা রেন্টাল-কুইক রেন্টাল এবং আইপিপির (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ প্রতি বছর বাড়ছে। সদ্যবিদায়ী অর্থবছর এ খাতে ব্যয় বাড়বে ৫৭ শতাংশের বেশি। যদিও এ সময় আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসে ছিল। তবে আদানিসহ বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোদমে উৎপাদন শুরু করায় গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর আইপিপি ও রেন্টাল-কুইক রেন্টালের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮১১ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে ব্যয় ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকারও কম। ওই অর্থবছর আইপিপি এবং রেন্টাল-কুইক রেন্টালের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২ হাজার ১৩৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ কর হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৮৯ মেগাওয়াট।
বিদায়ী অর্থবছর শুধু আদানির এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর আগের বছর আদানির একটি ইউনিট উৎপাদন শুরু করেছিল। মাত্র তিন মাসে ওই ইউনিটটির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছিল প্রায় ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদানির কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয়ই ২০২৩-২৪ অর্থবছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে।
এর বাইরে রামপাল, এসএস পাওয়ার, ইউনিক মেঘনাঘাটসহ বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গত অর্থবছর উৎপাদন শুরু করেছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ এক লাফে ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আগামীতে এ খাতে ব্যয় আরও বাড়বে বলেই মন্তব্য তাদের।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল আট হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১০ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এর আগের বছরগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ৯ হাজার কোটি টাকারও নিচে ছিল।
সূত্রমতে, গত ১৫ বছরে বেসরকারি খাতে ১০০টির বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও দরপত্রে একটিমাত্র কোম্পানি অংশ নেয়ায় তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। ফলে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স পায় সামিট। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে। ফলে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল এক হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৫০৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৭৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। সে সময় ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
পরের (২০১১-১২) অর্থবছর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় তিন হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছর সক্ষমতা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর আইপিপিগুলো উৎপাদন শুরু করে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় এগুলোর চুক্তির মেয়াদ ছিল গড়ে ১৫ বছর। ফলে ওই অর্থবছর থেকে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস পেতে শুরু করে।
২০১৪-১৫ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছর বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছর কয়েকটি রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ছয় হাজার ২৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর বেসরকারি খাতের সক্ষমতা আবার বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। এজন্য সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ডিজেলচালিত নতুন ছয়টি স্বল্পমেয়াদি আইপিপি যুক্ত হওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা সামান্য বাড়লেও ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেড়ে যায়।