Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:30 pm

‘ক্যাপিটালিজম’ নয় টেকসই উন্নয়নে ‘হ্যাপিটালিজম’ গুরুত্বপূর্ণ হোক

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য কী? যুগে যুগে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মানুষ। মানব জীবনের উদ্দেশ্য ‘সুখে থাকা’। বিভিন্ন গবেষণায় এই বিষয় খুবই জোরালোভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, আর তাই এ কথা স্বীকার করতেই হয়। সাহিত্য, সংগীত বা শিল্পকলায় সুখ নিয়ে আছে বহু উচ্চারণ, উপস্থাপন। কোথায় এর ঠিকানা, নাকি সুখ শুধুই ‘সোনার হরিণ’? এ নিয়ে বহু কথা বলেছেন মহান দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে তাদের মধ্যে মতভিন্নতাও কম নয়। সুখ মানেই মানবিক অনুভূতি। সুখ মনের অবস্থা বা অনুভূতি যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুখ ক্ষণিকের অনুভব। মানুষের আকাক্ষা যখন তৃপ্ত থাকে সেটাই সুখ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক কিছু হারিয়েও মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাড়ি ফিরে, তখন সেটা ছিল তাদের সুখের মুহূর্ত।

আভিধানিক অর্থে সুখ মানে একধরনের তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি। নিঃসন্দেহে সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার সুখ আর সংগীতপ্রেমী কারও গান শোনার সুখ কি এক হতে পারে? নিশ্চয়-ই পারে না। সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করার তেমন কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি নেই। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্য মতে, আপনি কীভাবে জীবনযাপন করেন, সুখ নির্ভর করে তার ওপর। অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান, ভালোবাসা, সম্পর্ক আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এসব বিষয়ে একেকজনের একেক মত থাকবে। আর যা আপনাকে সুখী করবে, তা অন্যকে নাও করতে পারে। এটা নিশ্চিত যে ব্যক্তিভেদে সুখের উৎস তাই ভিন্ন। জীববিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, সুখ হচ্ছে একটি জৈব চেতনা। এছাড়া তিনটি বিশেষ অবস্থাকেও বিবেচনা করা হয়: আনন্দ, অঙ্গীকার এবং অর্থ। জৈবিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দর্শনভিত্তিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং এর উৎস নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যদিও সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের মতে, ‘সুখের জš§ হয় মনের গভীরে। এটি কখনও বাইরের কোনো উৎস থেকে আসে না।’

ব্যক্তিগত স্তরে অনুভূতির পরিমাপ নির্ণয় বেশ জটিল। সুখ কিন্তু শুধু-ই ব্যক্তিগত বিষয় নয়। রাষ্ট্র এবং সমাজ সুখের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের চেয়ে পুরুষেরা কম সুখী। নারীদের বেশি সুখী হওয়ার কারণ তারা অল্পে তুষ্ট থাকেন। সুখকে ইতিবাচক কর্ম ও আবেগগুলোর সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অসহিষ্ণুতা, আয়বৈষম্য, দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিও জীবনকে জর্জরিত করে তোলে। ২০২২ সালে দ্য গুড লাইফ বইয়ে রবার্ট ওয়ালডিংগার ও মার্ক শুলজ অবশ্য সুসম্পর্ককেই ‘সুখী জীবনের মন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

‘সুখ’ পরিমাপের ধারণাটা এসেছে হিমালয়কোলের ছোট্ট দেশ ভুটান থেকে। ১৯৭৯ সালে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) বিমানবন্দরে এক সাংবাদিককে ভুটানের রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক বলেন, মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) চেয়ে গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গড় আয় বা (মোট জাতীয় উৎপাদনের) দিয়ে নাগরিকের সুখ পরিমাপ করা সম্ভব নয় এবং সঠিকও নয়। মানুষের ব্যয় করার সামর্থ্য ও কত কম ব্যয় করে মৌলিক চাহিদা পূরণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে সেটার ওপর সুখ অনেকাংশে নির্ভর করে। ২০০৮ সালে ওই বিষয়টি আবার সামনে আনে ভুটান। বাকি দেশগুলো তা অনুসরণ করে। যদিও সুখ পরিমাপের মানদণ্ড অনেকটা বদলে গেছে। এরপর ২০১২ সাল থেকে প্রকাশ করা হচ্ছে ‘বিশ্ব সুখ সূচক’।

সুখ নিয়ে জাতিসংঘের এ বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখছে দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটান। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দিয়ে দেশের নাগরিকদের অগ্রগতি বা সফলতা পরিমাপ না করে মোট জাতীয় সুখ দিয়ে (জিএনএইচ-গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) তা পরিমাপ করে থাকে। দেশটি সেই ১৯৭০-এর দশক থেকেই জাতীয় আয়ের চেয়ে জাতীয় সুখকে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। দেশটির চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক এই নীতির প্রবর্তক। মোট জাতীয় উৎপাদনের চেয়ে মোট জাতীয় সুখকে তারা প্রাধান্য দিয়ে আসছে। যার দৃষ্টান্ত এ পৃথিবীতে বিরল।

২০১২ সালে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্র ভুটান কর্তৃক প্রবর্তিত এ যুগান্তকারী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার প্রতি সহমত প্রকাশ করে এবং একটি প্রস্তাব পাস করে। ২০ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ বা ‘বিশ্ব সুখী দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সুখের অনুসন্ধান একটি মৌলিক মানবিক লক্ষ্য। জাতিসংঘ ‘সুখে থাকা’কে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শিক্ষা এবং সুস্থতার সঙ্গে সুখের সম্পর্ক রয়েছে। যারা যত বেশি শিক্ষিত, তারা তত বেশি সুখী আবার যাদের স্বাস্থ্য ভালো, তারাও তুলনামূলকভাবে সুখী। এটা হলো সুখের ব্যক্তিগত নানা রকমভেদ।

সুখের অন্বেষণে জীবনের আদর্শের মানদণ্ডও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, সুখের অন্তরায় হচ্ছে মূলত তিনটি বিষয়-দারিদ্র্য, বৈষম্য ও পরিবেশদূষণ। তাই দুর্নীতির বিস্তার, আয়বৈষম্যের বৃদ্ধি, ক্ষুধা, বেকারত্ব ও ভয় নিয়ে সুখে থাকা যায় কি? সুখের জন্য জিডিপি-কেন্দ্রিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই শেষ কথা নয়। আর্থিক প্রবৃদ্ধির বাইরেও কথা থাকে। স্থানীয় পরিবেশ মানুষের সুখের ওপর প্রভাব ফেলে। উন্নয়ন যদি টেকসই হয় তবে সুখও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

সুখী রাষ্ট্রের তালিকা তৈরি করার কাজটি খুব সহজ ছিল না। প্রলয়ঙ্করী বৈশ্বিক করোনা মহামারির থাবা আর যুদ্ধের ত্রাসের মধ্যে সুখী দেশের তালিকা তৈরি করা বেশ কঠিন কাজ। করোনায় প্রায় ৪৭ কোটি মানুষ আক্রান্ত এবং প্রায় ৬১ লাখ মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা সংঘাতের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের অসংখ্য আহত, নিহত, বাস্তুচ্যুত মানুষের আহাজারির মধ্যেও প্রণীত হয়েছে সুখী দেশের তালিকা, যার আনুষ্ঠানিক নাম ডড়ৎষফ ঐধঢ়ঢ়রহবংং জবঢ়ড়ৎঃ (ডঐজ)।

বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজার আকাশচুম্বী। কিছু পণ্য তো রীতিমতো রেকর্ড গড়ে বসে আছে, যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলছে। রমজান মাসে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মূল্যের গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বাড়ছে। আর মাংস উৎপাদন বাড়ছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। তারপরও প্রাণিজ এসব আমিষের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এবং বাজারে অস্থিরতা রয়ে গেছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ঠিক আগে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে মাংসের বাজার। ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ২৫০ টাকা ছাড়ছে, সোনালি মুরগির দামও বাড়ছে। গরুর মাংসের দাম প্রতিকেজি ৮০০ টাকায় এবং খাসির মাংস কোথাও কোথাও প্রতিকেজি ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল গড়ে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ২০১৪ সালের তুলনায় এখন গরুর মাংসের দাম এখন ১৫০ শতাংশের বেশি। এছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন’ শীর্ষক ২০২২ সালে প্রকাশিত প্রান্তিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি)-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।

রাজধানী ঢাকায় বাস করেন সীমিত আয়ের অনেক মানুষ, তাদের মধ্যে অবিবাহিত চাকরিজীবী ও বেকার মানুষের বড় একটি অংশ সাবলেট থাকে। আর্থিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় খারাপ হওয়ার কারণে ও মূল্যস্ফীতির চাপে অনেক মানুষ সাবলেট নিতে বা দিতে বাধ্য হয়েছেন। সে কারণে তারা নানাভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিল না। মোট জনসংখ্যার হিসাবে শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু ও তরুণের এই সংখ্যা ২ কোটি ৬২ লাখের বেশি। সেখানে শিক্ষাবহির্ভূত জনসংখ্যার বিষয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর জরিপে এই প্রবণতার প্রতিফলন দেখা গেছে।

এখানে শেষ নয়, করোনা মহামারির সময় মানুষের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মানুষের শহর ছাড়ার প্রবণতা কমেনি; বরং আর্থসামাজিক কারণে বছর বছর শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ছে। কাজ হারিয়ে জীবিকা অনিশ্চয়তার কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি বাড়ছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজারের মধ্যে প্রায় ৬ জন শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছে। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে প্রায় ১৪। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ প্রতিবেদনে অভিবাসন বিষয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগকারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৬৪টি পরিবারের সদস্য উম্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। বাংলাদেশে এখন দশমিক ৯৪ শতাংশ পরিবারের সদস্য উম্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। দেশে খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ ৩৩ হাজারের কিছু বেশি। ২০২২ সালে এই হার ছিল দশমিক ৭৭ শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। যদিও এসডিজি’র ৬ নম্বর লক্ষ্য অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমানে যারা আয়বৈষম্যের কারণে প্রোর্টিনের চাহিদা মেটাতে পারে না, যারা কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছে, তারা কেউ-ই সুখি নয়। যারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত অথবা আর্থিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় খারাপ হওয়ার ও মূল্যস্ফীতির চাপে কারণে সাবলেট থাকে এবং যারা খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করে, তারাও সুখে নেই। অর্থের অভাবে যদি ন্যূনতম মৌলিক মানবীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না, তখন তাকে সুখী বলা যায় না। ২০২১ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ম্যাট কিলিংসওয়ার্থ এক গবেষণায় দেখালেন, অর্থকড়ির সঙ্গে ভালো থাকা বাড়তেই থাকে; এর কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। এই যদি হয় অর্থের সঙ্গে সুখের ‘সম্পর্ক’, তবে বোঝা যাচ্ছে অর্থকে বাদ দিয়ে ‘সুখ’ পাওয়া সম্ভব নয়।

জাতিসংঘের এই ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে পরপর সাত বছর বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের শীর্ষ অবস্থানে আছে ফিনল্যান্ড। পর পরেই রয়েছে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। সুখী দেশের তালিকায় আমেরিকার স্থান ১৬, ব্রিটেন ১৭ নম্বরে রয়েছে। এ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ১৪৩টি দেশের তালিকায় ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯তম অবস্থানে। আর বাংলাদেশের স্কোর হলো ১০-এর মধ্যে ৩.৮৮৬। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১৮। সে হিসাবে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১ ধাপ পিছিয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ছিল তালিকার ৯৪ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া সবাই বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে।

সুখী দেশের তালিকায় ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। দেশে মাথাপিছু আয় ও জিডিপি’র হার বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, দারিদ্র্য কমছে, জীবন আয়ুষ্কাল বাড়ছে, তাহলে কেন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে? তাহলে কি কথিত বা দৃশ্যমান অবকাঠামো-কেন্দ্রিক উন্নয়ন মানুষের সুখ কেড়ে নিচ্ছে? জীবনের গুণগত উন্নয়ন কি তাহলে হচ্ছে না? ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বিশ্ব সুখ জরিপের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ। কারণ, তখন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক-সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বেশ গভীর ছিল। সামাজিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ বিরাজমান রয়েছে, যদিও তা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত বা হ্রাস পাচ্ছে। সেই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ৪৬তম। আর যুক্তরাজ্য ৩২তম আর ভারত ৫ম অবস্থানে ছিল। যদিও ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। এ রিপোর্টে বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), গড় আয়ু, মানবিকতা, সামাজিক সহায়তা, স্বাধীনতা ও দুর্নীতির ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশগুলোর তালিকা করা হয়।

উল্লেখ্য, এক দশক আগেও সারা পৃথিবীর সরকারগুলো বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কেন্দ্রে ‘সুখ’ নামক ধারণাকে রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আগ্রহী না হলেও প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে তাদের আগ্রহ ও ইচ্ছা বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। বিশ্ব সুখের প্রতিবেদনের ফলে বিশ্বব্যাপী মানবিক সুখের মাধ্যমে বৃহত্তর কল্যাণের পথ খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বৈশ্বিক সংকল্প বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাতিসংঘ কর্তৃক ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব মানুষের জীবনে সুখ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নতুন অর্থনৈতিক প্যারাডাইম (এনইপি) নামের একটি প্রকল্প চালু করা হয়। ২০১৯ সালে এ প্রকল্প থেকে বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও মানুষকে ‘পুঁজিবাদ’ বা ‘ক্যাপিটালিজমের’ পরিবর্তে ‘হ্যাপিটালিজম’ নামক নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আহ্বান করা হয়। হ্যাপিটালিজম হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দর্শন, যা মূলত সব মানুষের স্বাধীনতা, মঙ্গল ও সুখের নিশ্চয়তা বিধান করবে। মোট জাতীয় সুখ পরিমাপ করার জন্য অর্থনৈতিক সমতা, পারিবারিক বন্ধন, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এ নীতির অন্যতম এক উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের নাগরিকেরা পরস্পরের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। এ বন্ধন হবে নিরাপদ এবং সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন। মানুষে মানুষে এ বন্ধন সুগভীর বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে একজন নাগরিক অন্যজন কর্তৃক কখনোই আক্রান্ত হবে না। এ নীতিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তেমনি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রত্যেক জাতিসত্তার নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং সুশাসনের মতো বিষয়গুলোকে। এসব বিষয় পরিমাপের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট সূচক।

আগে মানুষের ধারণা ছিল, অর্থ বা সম্পদ থাকলেই মানুষ সুখী হতে পারে। কিন্তু জরিপে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ওই জরিপে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি-সম্পর্ক, সুস্বাস্থ্য ও পেশাগত বা চাকরিতে সন্তুষ্টিই ছিল মুখ্য। তবে ওই জরিপে দেখা গেছে, সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০ বছর ব্যাপ্তিতে মানুষের মধ্যে সুখ কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাজ্যসহ আরও অনেক দেশের তথ্য-উপাত্তে প্রতিফলিত এটা হতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যকে সকল সুখের মূল হিসেবে গণ্য করা হলেও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও উন্নত পরিবেশে বেড়ে ওঠা অনেক মানুষ আছেন, যারা প্রকৃত অর্থে সুখী নয়। অন্যদিকে, মানসিকভাবে ভালো থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা অনেকেই ভীষণ সুখী। এ রকম অনেক উদাহরণ আমাদের আশপাশে আছে।

মানুষকে সুখী করার পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতেও থাকতে পারে সুখী হওয়ার উপাদান। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফিনল্যান্ডের মানুষের সুখী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে তাদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা বা বহিঃপ্রকাশ না করে অনাড়ম্বর বা সাদামাটা জীবনযাপন করা। একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে সুখী হওয়া যায়। ‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’ এই আশার ভেলা ডুবতে দেয়া যাবে না।

আইনজীবী