ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ৫৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, সরকারি চাকরিতে ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং উন্নত ক্যারিয়ার গড়তে প্রায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এছাড়া ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখছেন। তবে শিক্ষাজীবনের মাঝামাঝিতে এসেও এখনও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কিছুই ভাবছেন না প্রায় ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সারা দেশের ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট এক হাজার ৫৭০ শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত একটি জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি পরিচালনা করেছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন।

আঁচল ফাউন্ডেশন গতকাল শুক্রবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’ শিরোনামে জরিপের তথ্য তুলে ধরে।

জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, আঁচল ফাউন্ডেশন শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের ক্যারিয়ার ভাবনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলার পর উঠে এসেছে বিভিন্ন চমকপ্রদ তথ্য। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে চান, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, মাত্র ৭ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। এছাড়া বাকি শিক্ষার্থী এখনও কোনোরূপ ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক করেননি, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২২ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জরিপে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের হতাশার বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে। মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। বিভিন্ন কারণে নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করার কারণে হতাশায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন মোট শিক্ষার্থীর ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিয়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, হল বা আবাসিক পরিবেশ নিয়ে ৯ শতাংশ, সহপাঠী বা শিক্ষক কর্তৃক বুলিংয়ের কারণে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্টÑএই প্রশ্ন ছিল সবার কাছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে পুরোপুরি অসন্তুষ্ট ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, মোটামুটি সন্তুষ্ট ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টি পরবর্তী সময় বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।

এমনকি জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের মাথায় আত্মহত্যা চিন্তা এসেছে এবং সেসব শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা ভাবনার পেছনে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা।

এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ শতাংশ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায়, ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমানের ফলে, ৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রেমঘটিত বিষয়ে, ৯ শতাংশ অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে, অন্যরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করার চিন্তা এসেছে বলে জানিয়েছেন।

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার উপসর্গ নিয়ে তুলনা করতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার উপসর্গ অনুভব করার হার বেশি। ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা এই ধরনের বিষণ্নতার উপসর্গগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। বাকি ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের মাঝে হতাশার উপসর্গ দেখা যায়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র তুলনামূলকভাবে কম। ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা হতাশার উপসর্গগুলো অনুভব করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা এ ধরনের উপসর্গের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। এবং উপর্যুক্ত সব কারণের জন্য ১ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া আরও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য কারণে হতাশায় ভুগছেন।

ক্যাম্পাস জীবন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আড্ডাবাজি, খুনসুটি, হৈ-হুল্লোড়; এককথায় প্রাণবন্ত মুহূর্তের চিত্রপট। কিন্তু এই সুখস্মৃতির মুহূর্তগুলোর পাশাপাশি ক্যাম্পাস জীবনে হতাশার গল্পও থাকে অনেকের। সহপাঠী, সিনিয়র, কিংবা শিক্ষক কর্তৃক ক্যাম্পাসে শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়াই ক্যাম্পাস বুলিং।

জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩১ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী, যার মাঝে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, র?্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, যৌন  হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুলিং, র?্যাগিং ও যৌন হয়রানির তিক্ততা যখন কোনো শিক্ষার্থীকে গ্রাস করে, তখন সে নিজেকে যাবতীয় সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয় এবং ধীরে ধীরে বিষণ্নতার দিকে ধাবিত হয়।

হয়রানিতে এগিয়ে সহপাঠী ও সিনিয়ররা। বিভিন্ন ধরনের হয়রানিতে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহপাঠী বা সিনিয়র দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ, শিক্ষক কর্তৃক ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, স্টাফ কর্তৃক ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং অন্যদের দ্বারা ৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়েছেন। হয়রানির ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর, মোটামুটি প্রভাব পড়েছে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর এবং কোনোরূপ প্রভাব পড়েনি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর।

হলের পরিবেশও প্রভাব ফেলছে বিষণ্নতায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেকেই হল বা ডর্মেটরিতে অবস্থান করে। হলে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার পরিবেশও একজন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। হলের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টির কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা জানিয়েছেন তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট।

অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে জরিপে দেখা গেছে, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী থাকার পরিবেশকে দায়ী করেছেন। অনুন্নত খাবারকে দায়ী করেছেন ৭ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। রিডিং রুম বা গ্রন্থাগারের সংকট মনে করছেন ৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং সব কারণকেই দায়ী করছেন ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ১০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা অন্যান্য কারণকে অসন্তুষ্টির জন্য দায়ী করছেন। ৭০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন হলের পরিবেশ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ডিপার্টমেন্ট অব সোশাল সায়েন্সেস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক, এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল হারুন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০