নিজস্ব প্রতিবেদক : কোরবানির পশুর হাট মানেই মানুষের ভিড়, হুড়োহুড়ি, গরু-ছাগলের সমাহার, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক ও দর কষাকষি। সব মিলিয়ে যারা হাটে ক্যাশ টাকা নিয়ে গরু কিনতে যান বা গরু বিক্রির পর বিক্রেতারাও কাছে টাকা রাখতে ভয় পান। এমন সব সমস্যার কথা মাথায় রেখে এবার রাজধানীর বেশ কয়টি হাটে থাকছে ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ক্যাশ টাকা বহন করা ছাড়াই গরু কিনতে পারবেন।
অন্যদিকে বিক্রেতারও গরু বিক্রির টাকা ক্যাশ হাতে না নিয়ে সরাসরি তাদের ব্যাংক বা ডিজিটাল লেনদেনের যে কোনো অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারবেন।
কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে প্রচুর টাকার লেনদেন হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কোরবানির পশুর হাটে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি এবং নকল বা ছেঁড়া/ফাটা নোট-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান হবে।
ডিএনসিসি বলছে, এতে ছিনতাই, মলম পার্টির খপ্পর থেকে রক্ষা পাবে ক্রেতা ও বিক্রেতারা। ২০২২ সালে স্মার্ট ডিএনসিসির কোরবানির হাটে পাইলট কার্যক্রমে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল। ২০২৩ সালে ৪৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ বছর এই লেনদেন আরও বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘লেনদেন হচ্ছে ক্যাশলেস, স্মার্ট হচ্ছে বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ডিএনসিসির কোরবানির পশুর হাটে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার আওতায় থাকছে ছয়টি কোরবানির পশুর হাট। এসব হাটে ক্যাশ টাকা ছাড়াই ডিজিটাল উপায়ে মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে কোরবানির পশু কিনতে পারবেন গ্রাহকরা।
যেসব হাটে এই ডিজিটাল লেনদেন থাকবে, সেসব হাট হলোÑউত্তরা দিয়াবাড়ী ১৬ ও ১৮নং সেক্টর-সংলগ্ন খালি জায়গায় কোরবানির পশুর অস্থায়ী হাট, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন খালি জায়গায় কোরবানি পশুর অস্থায়ী হাট, মিরপুর সেকশন-০৬, ওয়ার্ড নং-০৬ (ইস্টার্ন হাউজিং) খালি জায়গায়, ভাটারা সুতিভোলা খাল-সংলগ্ন খালি জায়গায়, মিরপুর গাবতলী গবাদি পশুর হাট (স্থায়ী) ও মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তাসংলগ্ন খালি জায়গা।
ডিএনসিসির কোরবানির পশুর হাটে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, মাস্টারকার্ড, অ্যামেক্স, ভিসা, বিকাশ, নগদ ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ)।
এ বিষয়ে কথা হয় ভাটারা হাটে গরু নিয়ে আসা বেশ কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে। তাদের মধ্যে মোকাম্মেল হোসেন এসেছেন পাবনা থেকে, নিয়ে এসেছেন ছয়টি গরু। তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে এবার হাটে প্রায় ২০ লাখ টাকার গরু এনেছি। সব গরু তো আর একসঙ্গে বিক্রি হয়ে যায় না। যখন একটি-দুটি গরু বিক্রি হয় তখন কাছে কয়েক লাখ টাকা সঙ্গে থাকে। যে কারণে খুব ভয় লাগে, এবার শুনেছি হাটে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা আছে, এতে করে খুব সুবিধা হবে, গরু বিক্রির টাকা সরাসরি অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেব। এতে নিরাপদ থাকতে পারব। এই উদ্যোগে আমাদের মতো দূর-দূরান্ত থেকে আসা গরু বিক্রেতাদের খুব উপকার হয়েছে।
একই হাটে গরু কেনার জন্য এসেছিলেন খোরশেদ আলম নামের একজন ক্রেতা। তিনি বলেন, আজ মূলত গরু দেখতে এসেছি, দরদাম সম্পর্কে ধারণা নিতে। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে গরুর দাম বেশি। ঘুরে দেখলাম, জানলাম, এখানে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা আছে, তাই যেদিন গরু কিনব সেদিন আর ক্যাশ টাকা হাটে আনব না। গরু নেয়ার পর সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেব বিক্রেতার। এ ব্যবস্থাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে। এতে করে ক্রেতা যেমন নিরাপদে থাকবে, তেমনি বিক্রেতারাও নিরাপদে থাকবে। টাকার নিরাপত্তা নিয়ে ভয়, চিন্তা আর থাকবে না।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসির কোরবানির পশুর হাটে ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত হবে। কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে প্রচুর টাকার লেনদেন হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করতে ডিএনসিসির কোরবানির পশুর হাটে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি, নকল বা ছেঁড়া-ফাটা নোট-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হবে। ছিনতাই ও মলম পার্টির খপ্পর থেকে রক্ষা পাবে ক্রেতা ও বিক্রেতারা।
ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাটে ডিজিটাল বুথ স্থাপন করে অর্থ তাৎক্ষণিক ক্রেতার হিসাব থেকে বিক্রেতার হিসাবে পৌঁছে দেয়া হবে। হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের নগদ টাকা বহন করতে হবে না। হাটের বুথ থেকে ক্রেতারা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ ও পস মেশিন ব্যবহার করে, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস, কিউআর কোডের মাধ্যমে নগদ অর্থ তুলে হাট থেকে কেনা গরুর মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। পাশাপাশি হাটের হাসিলও দিতে পারবেন এই পদ্ধতিতে। একই সুবিধা ব্যবহার করে বিক্রেতারা তাদের কোরবানির পশু বিক্রির অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন।
এদিকে দেশের প্রচলিত কোরবানির পশুর হাটের পাশাপাশি সরকারের ডিজিটাল হাটসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইনে কোরবানির গরু-ছাগল বিক্রি হচ্ছে। কভিডের সময় থেকে ঈদে হাটে যাওয়ার বদলে অনলাইনে কোরবানি দেয়ার প্রচলন হয়, যা সেসময় জনপ্রিয়তাও পায়। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও অনলাইনে কোরবানির পশু ক্রয় ও কোরবানি পরিষেবায় অনেকেই আগ্রহী, যা পূরণ করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করছে, যার মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল হাট, কোরবানির ঈদ উপলক্ষেও বসছে সরকারের ডিজিটাল গরুর হাট। সরকারের একশপ প্রকল্প, এটুআই, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ ও ইউএনডিপির সহযোগিতায় এই হাট বসেছে।
এছাড়া আয়োজনে থাকছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)।
ডিজিটাল হাটে পশু বেচাকেনা প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো পরিচালিত ডিজিটাল হাটে ২৭ হাজার পশু বিক্রি হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তিন লাখ ৮৭ হাজার পশু বিক্রি হয় ডিজিটাল হাটে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে চার লাখ ৬৩ হাজার ৯৬টি পশু বিক্রি হয়েছে, যার মূল্য চার হাজার ২৩১ কোটি ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
এদিকে ডিজিটাল হাট ছাড়াও বেসরকারি মাধ্যমে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোরবানির পশু অনলাইনে বিক্রি করছে বেঙ্গল মিট, বিরাট হাট ২০২৪ ক্যাম্পেইন, পল্লি কোরবানির হাট, বিক্রয় ডটকমসহ নানা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে বিক্রি করছে। এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকেও অনেকে ঝামেলাহীন কোরবানির পশু কিনছেন।